বৃহস্পতিবার, ১৮ ডিসেম্বর ২০২৫, ০৩:২১ পূর্বাহ্ন
পরিবর্তন ডেস্কঃ একাত্তরের অগ্নিঝরা ১৭ মার্চ ছিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৫১তম জন্মদিন। উত্তাল মার্চের এ দিনে ভোর থেকে গভীর রাত পর্যন্ত সমাজের সর্বস্তরের মুক্তিকামী হাজার হাজার বাঙালি মিছিল করে বঙ্গবন্ধুর ধানমন্ডির ৩২ নম্বর রোডের বাসভবনে গিয়ে প্রাণপ্রিয় নেতাকে শুভেচ্ছা জানান। বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে অসহযোগ আন্দোলনের ১৪তম দিন ছিল ১৭ মার্চ। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও ইয়াহিয়া খানের মধ্যে টানা তৃতীয় দিনের মতো বৈঠক বসে একাত্তরের এ দিনে। বৈঠকে বঙ্গবন্ধু জনগণের গণতান্ত্রিক রায়ের ভিত্তিতে ক্ষমতা হস্তান্তর এবং ছয় দফার ভিত্তিতে সংবিধান প্রণয়নের প্রশ্নে অটল থাকেন। অন্যদিকে ইয়াহিয়া খান জনগণের ভোটে নির্বাচিতদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরে অস্বীকৃতি জানান। ফলে বৈঠকে শুরু হয় অচলাবস্থা। এক পর্যায়ে বঙ্গবন্ধু ও ইয়াহিয়া খানের মধ্যে আলোচনা ভেঙে যায়। বৈঠক শেষে প্রেসিডেন্ট ভবন থেকে বঙ্গবন্ধুর গাড়ি বের হয়ে আসে। আগের মতোই সাদা গাড়ির এক পাশে কালো পতাকা, অন্য পাশে বাংলাদেশের প্রস্তাবিত পতাকা উড়িয়ে বেরিয়ে এলেন বঙ্গবন্ধু। সাংবাদিকরা গাড়ি ঘিরে ধরলে বঙ্গবন্ধু গাড়ির ভেতর থেকে বেরিয়ে আসেন। সাংবাদিকদের প্রশ্ন, আজ আলোচনার ফলাফল কী? বঙ্গবন্ধু বলেন, বলার সময় আসেনি। এরপরই সাংবাদিকের এক প্রশ্নের জবাবে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘সংগ্রাম জোরদার হতে পারে।’ বৈঠক ভেঙে যাওয়ার খবর চারদিকে ছড়িয়ে পড়লে ঢাকার রাজপথে নেমে আসে জনতার ঢল। বায়তুল মোকাররম মসজিদ এলাকায় ছাত্র ইউনিয়নের প্রতিবাদ সমাবেশে ছাত্রনেতারা ঘোষণা করেন ‘বাংলার মানুষ এখন যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত। আর কোনো বৈঠক দরকার নেই। স্বাধীনতা ছাড়া আর কোনো পথ খোলা নেই।’ এদিনেই গভীর রাতে পাকিস্তান জেনারেলদের গোপন বৈঠক বসে ঢাকায়। মূলত ইয়াহিয়া খানের আলোচনা নাটকের আড়ালেই চলছিল ইতিহাসের নৃশংস হত্যাকান্ডের পরিকল্পনা। এ রাতেই প্রেসিডেন্ট ভবনে ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে টিক্কা খানের বৈঠক হয়। গভীর রাতেই জেনারেল খাদেম হোসেন রাজাকে চূড়ান্ত ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দেন। ঢাকায় সামরিক জান্তার বৈঠকে বাঙালি হত্যার নীলনকশা ‘অপারেশন সার্চলাইট’ চূড়ান্ত করা হয়। একাত্তরের এ দিনে টিক্কা খান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে উত্থাপিত নৃশংস কার্যকলাপের অভিযোগ তদন্তের নির্দেশ দিলে বঙ্গবন্ধু তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে বলেন, ‘সামরিক কর্তৃপক্ষ নিযুক্ত তদন্ত কমিশন মানি না।’ এদিন মহান নেতার জন্মদিনে তার কামনা কী, এক বিদেশি সাংবাদিকের এ প্রশ্নের জবাবে বঙ্গবন্ধু জন্মদিনের অনুভূতি ব্যক্ত করতে গিয়ে বলেন, ‘আমার জীবনের সবচেয়ে বড় কামনা জনগণের সার্বিক মুক্তি।’ সাংবাদিকদের অন্য এক প্রশ্নের জবাবে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘আমি আমার জন্মদিন পালন করি না। এই দুঃখিনী বাংলায় আমার জন্মদিন কী বা মৃতু্যদিনইবা কী? আমার আবার জন্মদিন কী? আমার জীবন নিবেদিত জনগণের জন্য।’ এদিন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান বাংলার মাটিতে পা দিয়েই বুঝে ফেলেছেন বাংলার স্বাধীনতা অনিবার্য- কার্যত পূর্ব পাকিস্তানের তার কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যে নির্দেশ দিচ্ছেন, বাংলার সব মানুষ তা অক্ষরে অক্ষরে পালন করছে। তাই ইয়াহিয়া খান পাকিস্তানের ঊর্ধ্বতন সামরিক-বেসামরিক কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেন এবং বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আলোচনার নামে সময়ক্ষেপণের পথ বেছে নেন। কিন্তু প্রতিটি বৈঠকেই বঙ্গবন্ধু বাঙালির মুক্তি ও স্বাধীনতার প্রশ্নে ছিলেন আপসহীন। যদিও সময় ও কালক্ষেপণের ফাঁকে ফাঁকে প্রতিদিন পশ্চিম পাকিস্তান থেকে সৈন্য ও অস্ত্র-গোলাবারুদ আসতে থাকে পূর্ব পাকিস্তানে এবং পাকিস্তানি সামরিক সরকার পূর্ববাংলায় দমননীতি ও ব্যাপক গণহত্যার জন্য নীলনকশা আঁকতে থাকে। বসে ছিল না স্বাধীনতা বাঙালিরাও। স্বাধীনতা সংগ্রামের জন্য ব্যাপক প্রস্তুতির অংশ হিসেবে এদিন ছাত্রছাত্রীরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ময়দানসহ বিভিন্ন এলাকায় কুচকাওয়াজ ও রাইফেল চালানোর প্রশিক্ষণ শুরু করেন। সব বয়স, পেশা ও শ্রেণির মানুষ বেরিয়ে আসতে থাকে রাজপথে। স্বাধীনতার অগ্নিমন্ত্রে দীক্ষিত বঙ্গবন্ধুকে আরও উজ্জীবিত করতে রাস্তায়, মাঠ-ময়দানে তখন গণসংগীত, নাটক, পথনাটক ও পথসভা করতে থাকেন স্বাধীনতাকামী শিল্পীরা।
All rights reserved © 2020-2024 dainikparibarton.com
অনুমতি ব্যতিত এই সাইটের কোনো কিছু কপি করা কপিরাইট আইনে দণ্ডনীয়।