শুক্রবার, ০৩ মে ২০২৪, ১২:৫৮ অপরাহ্ন

বিজ্ঞপ্তিঃ
আপনার আশেপাশে ঘটে যাওয়া তথ্য আমাদের জানান। যাচাই সাপেক্ষে আমরা প্রকাশ করার চেষ্টা করবো। ## আমাদের মেইল করুনঃ [email protected] অথবা [email protected]
আজকের সংবাদঃ

“যেনো ভুলে না যাই”

লেখার শুরুতে সকল ভাষা শহিদ ও ভাষা সৈনিকদের প্রতি রইলো বিনম্র শ্রদ্ধা ও ভালবাসা। ভাষার মাসে আজ এমন একজন ব্যাক্তিকে নিয়ে লিখবো যার নাম নতুন প্রজন্মের অনেকের কাছেই অজানা। এই দেশ ও জাতির জন্য তাঁর অপরিসীম আত্মত্যাগের ইতিহাস অনেকেই জানেন না।একজন বড় মাপের রাজনৈতিক ব্যাক্তিত্ব হওয়া সত্বেও প্রচারের অভাবে তাঁর নামটা এবং তাঁর আত্মত্যাগের ইতিহাস বিস্তৃত হয়ে যাচ্ছে।তিনি আমার বাবা শওকত আলী। একজন ভাষা সৈনিক ও মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক। ১৯১৮ সালের ২০-শে এপ্রিল পুরান ঢাকার গেন্ডারিয়ায় এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। ঢাকা গভ.মুসলিম হাই স্কুলে পড়াকালীন সময়ে রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত হয়ে পড়েন। একসময় গণতন্ত্রের মানসপুত্র হোসেন শহিদ সোহরাওয়ার্দীর সান্নিধ্য লাভ করেন। ‌ তরুণ বয়সে শওকত আলী চলে আসেন পুরান ঢাকার ১৫০ চক মোগলটুলীতে এবং সেখানে বসবাস শুরু করেন। তাঁর ১৫০ নম্বর চক মোগলটুলীর বাড়িটি ছিল একটি ঐতিহাসিক বাড়ি। এই বাড়িটি ছিল ভাষা আন্দোলন,স্বাধিকার ও স্বাধীনতা আন্দোলনের কর্মী বাহিনীর মিলনক্ষেত্র। রাজনীতি চর্চার সূতিকাগার, প্রগতিশীল মুসলিম লীগ ও মুসলিম ছাত্রলীগ কর্মীদের পার্টি হাউজ,পাকিস্তান আন্দোলনের ঘাঁটি। পরবর্তীতে আওয়ামী মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে এ ভবনের ভূমিকা ইতিহাসের অংশ।‌দেশভাগের পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কলকাতা থেকে তৎকালীন পূর্ব বাংলায় এসে প্রথমেই উঠেছিলেন বন্ধু শওকত আলীর ১৫০ চক মোগলটুলীর বাড়িতে এবং বছর কয়েক সেই বাড়িতেই তিনি অবস্থান করেন।

প্রথম যেদিন বঙ্গবন্ধু এই বাড়িতে আসেন সেদিনের ঘটনা বঙ্গবন্ধুর বয়ানেই শোনা যাক — ১৫০ নম্বর মোগলটুলীতে প্রথমে উঠব ঠিক করলাম। শওকত মিয়া মোগলটুলী অফিসের দেখাশোনা করে। মুসলিম লীগের পুরানা কর্মী। আমার বন্ধুও। শামসুল হক সাহেব ওখানেই থাকেন। ‘শামসুল হক সাহেব ও শওকত সাহেব আমাকে পেয়ে খুবই খুশি। শওকত আমাকে নিয়ে কী যে করবে ভেবে পায় না। তার একটা আলাদা রুম ছিল। আমাকে তার রুমেই জায়গা দিল। আমি তাঁকে শওকত ভাই বলতাম। সে আমাকে মুজিব ভাই বলত।’ (অসামাপ্ত আত্মজীবনী, পৃষ্ঠা-৮৩)। তৎকালে লীগ অফিস নামে অধিক পরিচিত ছিল বাড়িটি। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান,তাজউদ্দীন আহমদ,শামসুল হক,অলি আহাদ, কমরুদ্দিন আহমেদ,মোঃ তোয়াহা,খালেক নেওয়াজ খাঁন,এম.এ.ওয়াদুদ প্রমুখ নেতারা সেই সময় এই বাড়িতে বসবাস করতেন। ভাষা আন্দোলনের গুরুত্বপূর্ণ সাংগঠনিক কার্যক্রম এখান থেকেই পরিচালিত হতো। ‌শওকত আলী ছিলেন আওয়ামী মুসলিম লীগ ও পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য এবং জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এর অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ বন্ধু ও সহযোদ্ধা। বঙ্গবন্ধুর ঝড় -ঝঞ্জাময় জীবনে ঢাল হয়ে ছিলেন আমৃত্যু। ছাত্রলীগ, যুবলীগ, আওয়ামী লীগ নামক সংগঠনগুলো যাদের শ্রমে-ঘামে-অর্থে আজকের মহীরূহুতে পরিণত হয়েছে সেই অল্প কয়েকজনের একজন শওকত আলী। শুরুতে আওয়ামী লীগের কোষাধ্যক্ষের দায়িত্বও পালন করেছেন তিনি। আওয়ামী লীগ গঠনে শওকত আলীর ত্যাগ অসামান্য। বঙ্গবন্ধু নিজেও একাধিকবার সেই ‘ঋণে’র কথা বলেছেন। ১৯৪৯ সালের ২৩ শে জুন ঢাকার টিকাটুলিস্হ “রোজ গার্ডেন প্যালেসে” নতুন দল গঠনে কর্মী সম্মেলনের আহবান করা হয়। এই সম্মেলনকে সামনে রেখে ১৫০ চক মোগলটুলিতে প্রস্তুতিমূলক কর্মতৎপরতা শুরু হয়। ২৩ জুনের সম্মেলনের আয়োজনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন শওকত আলী।

বঙ্গবন্ধুর ভাষ্য, ‘কর্মী সম্মেলনের জন্য খুব তোড়জোড় চলছিল। আমরা জেলে বসেই সেই খবর পাই। ১৫০ মোগলটুলীতে অফিস হয়েছে। শওকত মিয়া  সকলের খাওয়া ও থাকার বন্দোবস্ত করত। সে ছাড়া ঢাকা শহরে কেইবা করবে ? (অসমাপ্ত আত্মজীবনী, পৃষ্ঠা-১২০)।‌২৩ শে জুনের সম্মেলনের আগে মওলানা ভাসানীকে গ্রেফতার করা হবে এরকম একটা খবর লোকমুখে ছড়িয়ে পড়ে। নতুন দল গঠন হচ্ছে আর এসময় যদি মওলানা ভাসানীকে গ্রেফতার করা হয় তাহলে বিরাট ক্ষতি হয়ে যাবে। তখন মওলানা ভাসানীকে আত্মগোপনে রাখতে রাতের অন্ধকারে কম্বল পেঁচিয়ে ঘোড়ার গাড়িতে করে সম্মেলন শুরুর দুই দিন আগে ভাসানীকে রোজ গার্ডেনে নিয়ে যাওয়ার মূল নায়ক ছিলেন শওকত আলী। ‌ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে ’৭১ পর্যন্ত নানা বৈরিতার ভেতর দিয়ে মুক্তিযুদ্ধকে সংগঠিত করতে সীমাহীন ত্যাগ স্বীকার করেছেন শওকত আলী।রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে প্রথম হরতাল হয়েছিল ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ। এই হরতাল সফল করতে শওকত আলীর অবদান অনস্বীকার্য। পিকেটিং এর এক পর্যায়ে পুলিশের আইজি কে সচিবালয়ে ঢুকতে বাধা দেওয়ায় পুলিশি নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন মারাত্মকভাবে,আটক হয়ে জেলেও ছিলেন। ১৯৫২ সালের সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের কেন্দ্রীয় কার্যকরী কমিটির সদস্য ছিলেন। একই সালের ফেব্রুয়ারি মাসে রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে রাজপথে যে ব্যাপক আন্দোলন হয়েছিল, শওকত আলী সে আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছেন। ভাষা আন্দোলন করার সময় সবচাইতে বেশী পুলিশী নির্যাতন নিপীড়নের শিকার হয়েছিলেন শওকত আলী। ১৯৪৮ সালে রাজপথে আন্দোলনরত অবস্হায় পুলিশের বেধড়ক লাঠিচার্জে শওকত আলী গুরুতর আহত হয়ে রাস্তায় লুটিয়ে পড়েন। বন্ধু শওকতকে রক্তাক্ত অবস্হায় দেখে তৎক্ষনাৎ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁকে রিক্সায় করে  হাসপাতালে নিয়ে যান (ছবি দ্রষ্টব্য)। ‌রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবীতে মিছিল,জনসভা, ছাত্রসভা,পিকেটিংসহ বিভিন্ন কর্মসূচিতে শওকত আলী  সক্রিয়ভাবে যোগ দিয়েছেন এবং বিভিন্ন জনসভায় বক্তব্য রেখেছেন। ভাষা আন্দোলনে নেতৃত্বদানের অপরাধে শওকত আলী ২ মার্চ ১৯৫২ তারিখে গ্রেপ্তার হন এবং বহুদিন জেলে আটক ছিলেন।‌লোভ লালসার ঊর্ধ্বে থেকে পরোপকারী এই মানুষটি আজীবন সাধারণ মানুষের পাশে থেকে রাজনীতি করে গেছেন। বড় পদ বা ক্ষমতার জন্য তিনি রাজনীতি করেননি।

৪০-এর দশকের ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ মোকাবিলায় শওকত আলী গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন। চরম দুঃসময়ে তিনি সার্বক্ষণিক দুর্ভিক্ষ পীড়িত মানুষের পাশে ছিলেন এবং সাহায্য সহযোগীতা করেছেন। সেই সময় সবার মুখে মুখে তিনি “দুর্ভিক্ষ শওকত” নামেই বেশী পরিচিতি পান। বয়োজ্যেষ্ঠ পুরান ঢাকাবাসী এখনো তাকে”দুর্ভিক্ষ শওকত” নামেই চেনে।পরবর্তীকালে জাতীয় ইতিহাসের অনেক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাবলির সঙ্গে শওকত আলীকে সম্পৃক্ত থাকতে দেখা গেছে। তিনি জাতির একজন গর্বিত সন্তান।
‌বঙ্গবন্ধুর মৃত্যু শোকে তার ঠিক দু’দিনের মাথায় মৃত্যুবরণ করেন শওকত আলী। ১৯৭৫ সালের ১৫ ই আগস্ট বঙ্গবন্ধু স্বপরিবারে নিহত হওয়ার দুঃসংবাদে শওকত আলী ব্রেইন স্ট্রোকে আক্রান্ত হন এবং চিকিৎসাধীন অবস্থায় ১৮ ই আগষ্ট ১৯৭৫ এ মৃত্যুবরণ করেন।

বর্তমান সরকারের আমলেই ভাষা আন্দোলনে তাঁর কৃতিত্বপূর্ণ ও গৌরবময় অবদানের জন্য ২০১১ সালে শওকত আলী মরণোত্তর একুশে পদকে ভূষিত হন। ঢাকা সিটি কর্পোরেশন ২০১০ সালে জাতির গর্বিত সন্তান শওকত আলীর নামে ধানমন্ডিস্হ ৪/এ সড়কটির নামকরণ করে।১৯৪৭ থেকে ১৯৫৬ পর্যন্ত দীর্ঘ পথ অতিক্রম করে বাংলা ভাষা রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা লাভ করে। যাদের বলিষ্ঠ নেতৃত্ব ও সাহসিকতায় সেদিন ভাষা আন্দোলন সফলতা লাভ করেছিল, ইতিহাসের পাতায় তাদের নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে।

মহিউদ্দিন আল আমান শাহেদ।ভাষা সৈনিক ও মুক্তিযোদ্ধা সংগঠক শওকাত আলীর সন্তান

সংবাদটি শেয়ার করুন

আর্কাইভ

MonTueWedThuFriSatSun
  12345
6789101112
13141516171819
20212223242526
2728293031  
       
2930     
       
    123
       
   1234
19202122232425
26272829   
       
22232425262728
293031    
       
      1
16171819202122
3031     
   1234
19202122232425
2627282930  
       
293031    
       
     12
3456789
17181920212223
       
  12345
2728293031  
       
  12345
6789101112
13141516171819
2728     
       
      1
3031     
   1234
19202122232425
262728293031 
       
282930    
       
     12
10111213141516
17181920212223
24252627282930
31      
   1234
567891011
2627282930  
       
15161718192021
293031    
       
    123
45678910
       
  12345
6789101112
13141516171819
20212223242526
27282930   
       
      1
9101112131415
3031     
    123
45678910
18192021222324
252627282930 
       
 123456
14151617181920
21222324252627
28293031   
       
 123456
28      
       
     12
17181920212223
31      
  12345
6789101112
20212223242526
2728293031  
       
891011121314
15161718192021
22232425262728
2930     
       
    123
11121314151617
25262728293031
       
  12345
27282930   
       
      1
3031     
   1234
567891011
       
       
       
    123
45678910
       
  12345
20212223242526
27282930   
       
     12
3456789
       
  12345
6789101112
13141516171819
20212223242526
2728293031  
       
All rights reserved © 2020-2023 dainikparibarton.com

অনুমতি ব্যতিত এই সাইটের কোনো কিছু কপি করা কপিরাইট আইনে দণ্ডনীয়।