শনিবার, ২২ ফেব্রুয়ারী ২০২৫, ১২:৩০ পূর্বাহ্ন
শওকত আলী : ভাষা সংগ্রামের অগ্রসেনানী
ভাষা সংগ্রামের এক মহানায়কের নাম শওকত আলী। তিনি ১৯১৮ সালের ২০শে এপ্রিল পুরাতন ঢাকার গেন্ডারিয়ায় এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। বাবা শমশের আলী ছিলেন বিশিষ্ট ব্যবসায়ী এবং মা মেহেরুন্নেসা খাতুন গৃহিনী। খুব ছোট বেলায় মা’কে হারিয়ে বাবা এবং মামা মামীর কাছেই বেড়ে ওঠেন শওকত আলী। ঢাকার ঐতিহ্যবাহী গভঃ মুসলিম হাই স্কুলে তাঁর শিক্ষা জীবন শুরু হয়। স্কুলের গন্ডি পেরোনোর আগেই তিনি রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত হন এবং গণতন্ত্রের মানসপুত্র হোসেন শহিদ সোহরাওয়ার্দীর সান্নিধ্য লাভ করেন। রাজনীতি চর্চার সুবিধার্থে তরুণ বয়সে শওকত আলী গেন্ডারিয়া থেকে চলে আসেন ১৫০,নম্বর চক মোগলটুলীর পার্টি অফিসের বাড়িতে। তাঁর এই বাড়িটি ছিল ভাষা আন্দোলন,স্বাধিকার ও স্বাধীনতা আন্দোলনের কর্মী বাহিনীর মিলনক্ষেত্র। রাজনীতি চর্চার সূতিকাগার হিসেবে পরিচিত ছিল এই বাড়ীটি। তিনি ছিলেন মুসলিম লীগের পুরানো কর্মী।
১৯৪৭’র ভাষা আন্দোলনের সুচনাপর্ব থেকেই শওকত আলী ওতোপ্রোতোভাবে এ-আন্দোলনের সাথে জড়িয়ে পড়েন এবং নেতৃত্ব দেন। ভাষা আন্দোলনের গুরুত্বপূর্ণ সাংগঠনিক কার্যক্রম তাঁর ১৫০,চক মোগলটুলীর পার্টি অফিস থেকেই পরিচালিত হতো। ১৯৪৭ এর ৩০-শে ডিসেম্বর “রশিদ ভবনে” অধ্যাপক আবুল কাশেমের নেতৃত্বে প্রথম “তমদ্দুন মজলিশের রাষ্ট্রভাষা উপ-কমিটি” গঠিত হয়। শওকত আলী এই কমিটির একজন সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হন। তিনি তিনটি রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদেরই সদস্য ছিলেন। ভাষা আন্দোলনের সব অধ্যায়ে শওকত আলী অত্যন্ত ঘনিষ্ঠভাবে সম্পৃক্ত ছিলেন এবং নেতৃত্ব দিয়েছেন।
বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা যায়-শওকত আলী,শামসুল হক,শেখ মুজিবুর রহমান,তাজউদ্দীন আহমদ,মোহাম্মদ তোয়াহা,অলি আহাদ,নঈমুদ্দিন আহমদ প্রমুখ যুবনেতার কঠোর সাধনার ফলে বাংলা ভাষার এই আন্দোলন একসময় গণআন্দোলনে রূপ নেয় এবং সমগ্র পূর্ব বাংলায় ছড়িয়ে পড়ে।
১৯৪৮ সালের ১১ই মার্চ ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসে একটি গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়। সেদিন স্বতঃস্ফূর্তভাবে সমগ্র পূর্ব বাংলার প্রায় সবগুলো জেলা শহরেই সরকারি ভাষা হিসেবে বাংলার স্বীকৃতির দাবীতে ছাত্র ধর্মঘট ও হরতাল পালিত হয়। ঢাকার রাজপথে ঐদিন ভোর থেকেই সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের নেতা কর্মীরা বিভিন্ন পয়েন্টে পিকেটিং শুরু করেন। পিকেটিংয়ের নেতৃত্বে ছিলেন শামসুল হক,শওকত আলী,শেখ মুজিবুর রহমান,কাজী গোলাম মাহবুব,আবুল কাসেম,মোহাম্মদ তোয়াহা,অলি আহাদ,শহীদুল্লা কায়সার,আবদুল মতিন,নঈমুদ্দীন আহমদ, খালেক নেওয়াজ খান প্রমুখ। হরতালের সমর্থনে সেক্রেটারিয়েটের দ্বিতীয় গেটে (তোপখানা রোড) পিকেটিং করেন শওকত আলী,কাজী গোলাম মাহবুব,বরকতসহ কয়েকজন। পিকেটিং এর এক পর্যায়ে পুলিশের আইজি জাকির হোসেন গাড়ী নিয়ে সচিবালয়ে প্রবেশের চেষ্টা করেন। এসময় শওকত আলী গাড়ির সামনে পা লম্বা করে সোজা মাটিতে শুয়ে পড়ে গাড়িটির পথরোধ করেন। পরবর্তীতে পুলিশের বেধড়ক লাঠিচার্জে তিনি মারাত্মকভাবে আহত হন এবং আটক হয়ে জেলে যান। এখানে বিশেষভাবে উল্লেখ্য যে,ভাষা আন্দোলন করার দায়ে সবচাইতে বেশী পুলিশী নির্যাতন নিপীড়নের শিকার হয়েছিলেন শওকত আলী।
পুরান ঢাকার উর্দুভাষী জনগণ (ঢাকাইয়া) প্রথম দিকে ভাষা আন্দোলনের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছিল। পরবর্তীতে ঢাকাইয়াদের আন্দোলনে সম্পৃক্ত করতে শওকত আলীর ভূমিকা ছিল অবিস্মরণীয়। এ প্রসঙ্গে বিশিষ্ট সাংবাদিক,পত্রিকা সম্পাদক ও ভাষা সৈনিক সানাউল্লাহ নূরী তাঁর ‘৪০-এর দশকের রাজনীতি এবং ভাষা আন্দোলনের স্মৃতি’-তে উল্লেখ করেছেন:
**চকবাজারে ছিলেন রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের অক্লান্ত কর্মী শওকত ভাই। তিনি ছিলেন ঢাকার স্থানীয় লোক। বিভাগ-পূর্বকালে মুসলিম লীগ সংগঠক হিসাবে পুরাতন শহরে সকলের সুপরিচিত ছিলেন তিনি। সুখে-দুঃখে সব সময় তিনি থাকতেন সাধারণ মানুষের পাশে। মিটফোর্ড রোড, চকবাজার,মওলবীবাজার এবং লালবাগ এলাকায় ছিলো তাঁর ব্যাপক জনপ্রিয়তা। এই মহল্লাগুলিতে প্রথম দিকে শওকত ভাইকে সাথে নিয়েই আমরা পোষ্টার লাগাতাম, বিলি করতাম প্রচারপত্র। স্ট্রিট কর্ণার মিটিংও করেছি অনেক। কেউ বাধা দেয়ার সাহস পায়নি। বরং স্থানীয় জনসাধারণ নানাভাবে আমাদের সাহায্য করেছেন। প্রচারপত্র ছাপানোর জন্য চাঁদা পর্যন্ত দিয়েছেন। এঁদের সমর্থনের ফলে আমরা গভীরভাবে উদ্বুদ্ধ এবং অনুপ্রাণিত হয়েছি। এই কথা সত্য,গোড়ার দিকে নানা রকম প্রতিবন্ধকতার কারণে আমরা অনেকটা হতাশ হয়ে পড়েছিলাম। কিন্তু যখন দেখলাম ঢাকার স্থানীয় জনসাধারণ ছাত্রদের পক্ষে আসতে শুরু করেছেন আমাদের মনোবল তখনই প্রচন্ডভাবে চাঙ্গা হয়ে উঠলো।** (ঐতিহ্য : মহান ভাষা আন্দোলন স্মারক,ফেব্রুয়ারী-১৯৮৬,মোঃ লুৎফল হক)
ভাষা আন্দোলনে নেতৃত্বদানের অপরাধে শওকত আলী ২ মার্চ ১৯৫২ তারিখে পুনরায় গ্রেপ্তার হন এবং বহুদিন জেলে আটক ছিলেন। (সূত্র: সাপ্তাহিক সৈনিক, ২২ ফেব্রুয়ারি, ১৯৫৩)। পরবর্তীকালে জাতীয় ইতিহাসের অনেক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাবলির সঙ্গে শওকত আলীকে সম্পৃক্ত থাকতে দেখা যায়।
লোভ লালসার ঊর্ধ্বে থেকে পরোপকারী এই মানুষটি আজীবন সাধারণ মানুষের পাশে থেকে রাজনীতি করে গেছেন। বড় পদ বা ক্ষমতার জন্য তিনি রাজনীতি করেননি। জীবনে অনেক বড় বড় প্রস্তাব তিনি বিনয়ের সাথে ফিরিয়ে দিয়েছেন।
বর্তমান রাজনীতিতে ভাষা সৈনিক শওকত আলীর মত নিঃস্বার্থ,ত্যাগী,আদর্শিক নেতার বড়ই অভাব। ভাষা আন্দোলন থেকে মুক্তিযুদ্ধ- বাঙালির দীর্ঘ সংগ্রামের ইতিহাসের সাথে জড়িয়ে আছে শওকত আলীর নাম। কিন্তু,অত্যন্ত দুঃখের সাথে বলতে হচ্ছে,নানা কারণে যেসব ভাষা সৈনিক ও মুক্তিযুদ্ধের সংগঠকদের অবদান ও সীমাহীন আত্মত্যাগ আড়ালে পড়ে গেছে তাঁদের মধ্যে অন্যতম একজন শওকত আলী। আজকাল তো ইতিহাস চর্চাও লাভালাভের বিষয় হয়ে দাড়িয়েছে। সেদিক থেকে শওকত আলীর নাম উচ্চারণে দুই পয়সার লাভ নেই জেনেই হয়তো কেউ কেউ তাঁর সম্বন্ধে লেখে না বা খোঁজ নেয় না। মহান এই ভাষা সৈনিক ও মুক্তিযুদ্ধের সংগঠকের জন্ম,মৃত্যু কিংবা কর্ম তাই আলোচনার আড়ালেই থেকে যায়। প্রচারের অভাবে দেশ ও জাতির জন্য শওকত আলীর অপরিসীম আত্মত্যাগ ও অবদানের কথা তাই তরুণ প্রজন্মর কাছেও অজানা রয়ে গেছে। হাতে গোণা কয়েকজন লেখক যারা আমার বাবা সম্বন্ধে বিভিন্ন সময় লিখেছেন,তাঁদের কাছে আমি চিরকৃতজ্ঞ। সন্তান হিসেবে আমি আমার দায়িত্ববোধ থেকে দেশ ও রাজনীতিতে আমার বাবা শওকত আলীর অবদানের কিছু তথ্য তুলে ধরার চেষ্টা করেছি মাত্র।
১৯৪৭ থেকে ১৯৫৬ সাল- দীর্ঘ পথ অতিক্রম করে বাংলা ভাষা রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা লাভ করে। যাদের বলিষ্ঠ নেতৃত্ব ও সাহসিকতায় সেদিন ভাষা আন্দোলন সফলতা লাভ করেছিল,ইতিহাসের পাতায় তাদের নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। ভাষা আন্দোলনের চেতনার সন্দীপনে বাঙালী জাতি যখন মুক্তিযুদ্ধের সংগ্রামে লিপ্ত তখনও বর্ষিয়ান ভাষা সংগ্রামী শওকত আলী একই প্রত্যয়ে ও উদ্দীপনায় সে সংগ্রামে মূল্যবান অবদান রেখে গেছেন। ১৯৭১-এ মুক্তিযোদ্ধাদের গোপন আশ্রয়স্হল ছিল শওকত আলীর বাড়িটি। ঐ বাড়িতে মুক্তিযোদ্ধাদের গোপন বৈঠকসহ নানাবিধ কার্যক্রম পরিচালিত হতো। মুক্তিযোদ্ধাদের থাকা ও খাওয়ার ব্যবস্থাও করা হতো খুবই সতর্কতা এবং গোপনীয়তা রক্ষা করে। শওকত আলী তাঁর নিজস্ব তহবিল থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের আর্থিক সহযোগিতাও করতেন। কয়েকবার এই বাড়িটি পাকিস্তান সেনাবাহিনী এবং তাদের দোসর রাজাকার,আলবদর বাহিনী দ্বারা আক্রান্ত হয়। তারা একাধিকবার শওকত আলীকে হত্যার অপচেষ্টা চালায় এবং ব্যর্থ হয়।
মহান এই ভাষা সৈনিক ১৯৭৫ সালের ১৮ আগস্ট ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন।
ভাষা আন্দোলনে শওকত আলীর কৃতিত্বপূর্ণ ও গৌরবময় অবদানের জন্য ২০১১ সালে তাঁকে মরণোত্তর একুশে পদকে ভূষিত করা হয়। ঢাকা সিটি করপোরেশন ২০১০ সালে জাতির এই গর্বিত সন্তানের নামে ধানমন্ডিস্থ ৪/এ সড়কটির নামকরণ করে।
★লেখক : মহিউদ্দিন আল আমান শাহেদ।
ভাষা সৈনিক ও মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক শওকত আলীর সন্তান।
All rights reserved © 2020-2024 dainikparibarton.com
অনুমতি ব্যতিত এই সাইটের কোনো কিছু কপি করা কপিরাইট আইনে দণ্ডনীয়।