সোমবার, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ০৪:০৫ পূর্বাহ্ন
পরিবর্তন ডেস্কঃ দেশের কোনো নদনদী আর নিরাপদ নেই। সব নদীতেই দখলদারদের কালোথাবা। উচ্ছেদ অভিযানের পর পুনরায় আবার দখল হয়ে যাচ্ছে। দেশের অভ্যন্তরে অধিকাংশ নদী এবং এর তীরবর্তী এলাকা দখল হয়ে যাওয়ায় অতীতের সেই সৌন্দর্য আর নেই। দেশের ২৩০টি নদীর সবকয়টির তীরবর্তী এলাকায় বিভিন্ন ব্যক্তি এবং প্রতিষ্ঠান অবৈধভাবে দখল করে বসতবাড়িসহ বিভিন্ন স্থাপনা নির্মাণ করেছে। ৫৩ জেলা ও মহানগরের ২৩০টি নদী ও খালের বিভিন্ন অংশ দখল করেছে ১০ হাজার ৭৬২ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান। দখলদারদের পৃষ্ঠপোষকতায় ১১৮ জন প্রভাবশালী ব্যক্তি। সম্প্রতি সরকারের প্রভাবশালী গোয়েন্দা সংস্থার চার ক্যাটাগরিতে ১ হাজার ৮৯ পৃষ্ঠার এক প্রতিবেদনে এই তথ্য পাওয়া গেছে। ছয়টি সুপারিশসহ প্রতিবেদনটি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, ভূমি ও নৌ-সচিবের দপ্তরে জমা দেওয়া হয়েছে। নদী দখল রোধে কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণের সুপারিশ করা হয়েছে।
নদী দখলের খবর পেলেই সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন নৌ-পরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী। তিনি বলেন, নদী বাঁচলে দেশ বাঁচবে, দেশের নদীগুলো নিয়ে ভাবতে হবে। নদীগুলোকে নিয়ে সরকার টাস্কফোর্স কমিটি গঠন করেছে, কমিটি নদী রক্ষায় কাজ করছে। নদী দখলদারদের সংখ্যা নিয়ে সম্প্রতি জাতীয় সংসদে এম আব্দুল লতিফ এমপির প্রশ্নের জবাবে নৌ প্রতিমন্ত্রী বলেন, দেশের ৬৪ জেলায় ৪৯ হাজার ১৬২ অবৈধ নদনদী দখলদার চিহ্নিত করা হয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, বর্তমানে নদনদীর সংখ্যা ২৩০টি। এর মধ্যে আন্তর্জাতিক নদনদীর সংখ্যা ৫৭টি। বর্তমানে বাংলাদেশে প্রবাহিত নদীগুলো আগের মতো ভালো নেই। দেশের বিভিন্ন স্থানে বিশেষ করে শহরাঞ্চলে রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে নদী ও খালের তীরবর্তী স্থান দখলে নিয়ে বসতবাড়ি, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ও স্থাপনা নির্মাণ করা হয়েছে। নদীর তীরবর্তী অনেক স্থানে অবৈধভাবে বালু তৈরি ও হাটবাজার বসানো হয়।
প্রতিবেদনে নদী-খাল দখলের ফলে যেসব সমস্যা তৈরি হয়েছে সে বিষয়ে বলা হয়, সারাদেশের বিভিন্ন স্থানে নদনদী, খাল ও বিল অবৈধভাবে দখল হয়ে যাওয়ায় পানি প্রবাহের গতিপথ পরিবর্তন হয়ে যাচ্ছে। নদনদী সংকীর্ণ হয়ে পড়েছে। ফলে বর্ষাকালে পানির প্রবাহ ব্যাহত হওয়ার পাশাপাশি অনেক স্থানে বৃষ্টির পানি জমে ফসল ও বাড়িঘর তলিয়ে যায়। এতে জনগণের ফসল ও ঘরবাড়ি ক্ষতি হয়। নদনদী, খাল-বিল অবৈধভাবে দখল ও ভরাট করায় প্রশস্ততা/গভীরতা হ্রাস পাচ্ছে। নদী-খাল দখলদারদের সঙ্গে সরকারি অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীর যোগসাজশ রয়েছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। এতে বলা হয়, নদী দখলদারদের সঙ্গে স্থানীয় ভূমি অফিস ও বিআইডব্লিউটিএর অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীদের যোগসাজশ রয়েছে। এছাড়া স্থানীয় সরকার দলীয়/ক্ষমতাসীন দলের বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের দৌরাত্ম্য রয়েছে। এতে সাধারণ জনগণের মধ্যে নেতিবাচক ধারণা তৈরি বা দলের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হচ্ছে। বিভিন্ন স্থানে উচ্ছেদ অভিযান চালানোর পর যথাযথ কর্তৃপক্ষের নিয়মিত মনিটরিং না করায় ফের দখল হয়ে যাচ্ছে।
প্রতিবেদনে অবৈধ দখলদারদের হাত থেকে নদী উদ্ধার করতে সারাদেশে একযোগে ভ্রাম্যমাণ অভিযান পরিচালনাসহ ছয়টি সুপারিশ করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে—উচ্ছেদ অভিযানে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টিকারীদের বিরুদ্ধে যথাযথ আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে স্থানীয় প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে নির্দেশনা দেওয়া যেতে পারে। নদী ও খাল দখলকারীদের পৃষ্ঠপোষকতাকারীদের স্থানীয় প্রশাসনের মাধ্যমে সতর্ক করা যেতে পারে। এমন কী সরকারি দলের কেন্দ্রীয় পর্যায় থেকেও তাদের সতর্ক করা প্রয়োজন। দখলদারদের বিরুদ্ধে স্থানীয় ভূমি অফিস, বিআইডব্লিউটিএ ও স্থানীয় প্রশাসনকে আরো সক্রিয় করা এবং দখলদারদের বিরুদ্ধে উচ্ছেদ অভিযান চালানোর পর তা নিয়মিত মনিটরিং করা। এছাড়াও নদী-খাল-বিলের সীমানা চিহ্নিতপূর্বক সীমানা নির্ধারণী খুঁটি স্থাপন করার পাশাপাশি প্রয়োজনে কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণ করতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দেওয়া যেতে পারে।
প্রতিবেদন অনুযায়ী দেশের ৫৩টি জেলায় ২৩০টি নদী-খাল দখল করেছে ১০ হাজার ৭৬২টি ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান। দখলদারদের পৃষ্ঠপোষকতাকারী প্রভাবশালীদের সংখ্যা ১১৮ জন। সবচেয়ে বেশি ২ হাজার ১৬০ জন দখলদার আছে ময়মনসিংহ জেলায়। এ জেলার দখলদাররা ৫৯টি নদী-খালের বিভিন্ন অংশ দখল করেছে। দ্বিতীয় অবস্থানে খুলনা। এ মহানগর এলাকায় ১ হাজার ২২৯ ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান দুটি নদীর বিভিন্ন অংশ দখল করেছেন। তাদের পৃষ্ঠপোষকতায় রয়েছেন দুই জন প্রভাবশালী ব্যক্তি। আর মহানগর বাদে খুলনা জেলায় সাতটি নদী-খালে দখলদার রয়েছে ৮৯ জন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান। ঢাকা জেলা ও মহানগর এলাকায় নদী দখল করেছে। এদের পৃষ্ঠপোষক আট জন। অন্যান্য জেলার মধ্যে গাজীপুরে চারটি নদীতে ৪১, টাঙ্গাইলের পাঁচটি নদীতে ৭৪, কিশোরগঞ্জের ১০টি নদীতে ১১৯, নারায়ণগঞ্জের পাঁচটি নদীতে ১৬৬, মানিকগঞ্জের চার নদীতে ২৬, মুন্সীগঞ্জের পাঁচ নদীতে ৪২, নরসিংদীর এক নদীতে ১৪, ফরিদপুরের তিন নদীতে আট এবং রাজবাড়ীর চার নদীতে ২৭ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান দখল করেছে। বাকি জেলাগুলোর মধ্যে গোপালগেঞ্জর দুই নদীতে ৪৩১, শরীয়তপুরে ১১ নদীতে ১২১, জামালপুরে সাত নদীতে ১৯৫, শেরপুরে সাত নদীতে ১৭৭, নেত্রকোনায় এক নদীতে ২৫, সিলেটে দুই নদীতে ১৯১, মৌলভীবাজারে চার নদীতে ১৮৩ জন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান দখলদার হিসেবে আছে। হবিগঞ্জের এক নদীতে ৩২, সুনামগঞ্জের আট নদীতে ১৮৮, চট্টগ্রামের দুই নদীতে ৭৯, কুমিল্লার দুই নদীতে ৩৭৩, ফেনীর এক নদীতে ৩৯, চাঁদপুরের তিন নদীতে ৭৪৪, রাঙ্গামাটির এক নদীতে ৫৩, বান্দরবানের এক নদীতে ৪৫, রংপুরের চার নদীতে ১৬৫, দিনাজপুরের এক নদীতে ৭৭৬, পঞ্চগড়ের দুই নদীতে ১৪, নীলফামারীর চার নদীতে ১১, ঠাকুরগাঁওয়ের এক নদীতে ২২৯, রাজশাহীর এক নদীতে ১১ ও বগুড়ার এক নদীতে ২৩ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান দখল করে আছে। পাবনার দুই নদীতে ২৯৭, সিরাজগঞ্জের দুই নদীতে ৫৫, নওগাঁর দুই নদীতে ১০৩, নাটোরের দুই নদীতে ৪৬৩, চাঁপাইনবাবগঞ্জের এক নদীতে ৫২, সাতক্ষীরার তিন নদীতে ১০৮, বাগেরহাটের পাঁচ নদীতে ২৬৩, যশোরের এক নদীতে ২৭, নড়াইলের তিন নদীতে ৮২, কুষ্টিয়ার চার নদীতে ১৭৯, ঝিনাইদহের পাঁচ নদীতে ১৩৪, মাগুরার তিন নদীতে ৫৪, বরিশালের দুই নদীতে ৩৯, ঝালকাঠির পাঁচ নদীতে ১১, পিরোজপুরের তিন নদীতে ২৭, বরগুনার দুই নদীতে ১০ এবং পটুয়াখালীর পাঁচ নদীতে ৬১৮ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান দখলদার রয়েছে।
All rights reserved © 2020-2024 dainikparibarton.com
অনুমতি ব্যতিত এই সাইটের কোনো কিছু কপি করা কপিরাইট আইনে দণ্ডনীয়।