শুক্রবার, ২২ নভেম্বর ২০২৪, ০৯:১২ অপরাহ্ন
ভাস্কর সরকার (রা.বি):
“সূর্যদয়ে তুমি, সূর্যাস্তেও তুমি
ও আমার বাংলাদেশ, প্রিয় জন্মভূমি॥
জলসিঁড়ি নদীর তীরে,
তোর খুশির কাঁকন যেন বাজে
ও—কাশবনে ফুলে ফুলে,
তোর মধুর বাসর যেন সাজে
তোর একতারা হায়,
করে বাউল আমায় সুরে সুরে॥
আঁকাবাঁকা মেঠো পথে
তোর রাখাল হৃদয় যেন হাসে
ও—পদ্ম পাতা, দীঘির ঝিলে
তোর সোনার স্বপন যেন ভাসে
তোর এই আঙিনায়
ধরে রাখিস আমায় চিরতরে॥”
উপরোক্ত লিরিকটি পড়ে নিশ্চই ঠাহর করতে পেরেছেন গানটির শিল্পী কে ? গানটি লিখেছেন মনিরুজ্জামান মনির ও সুর করেছেন আলাউদ্দিন আলী৷ আর গানটি কন্ঠে ধারন করে সমগ্র বাংলাদেশের পথে-প্রান্তরে, ঘাটে-মাঠে, গ্রাম-গঞ্জ-শহরের আনাচে কানাচে পৌঁছে দিয়েছেন কিংবদন্তি সঙ্গীত শিল্পী সৈয়দ আব্দুল হাদী৷
সৈয়দ আব্দুল হাদী ১৯৪০ সালের ১ জুলাই ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার কসবা উপজেলার শাহপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। বেড়ে উঠেছেন আগরতলা, সিলেট, ব্রাহ্মণবাড়িয়া এবং কলকাতায়। তবে তার কলেজ জীবন কেটেছে রংপুর আর ঢাকায়। তার পিতার নাম সৈয়দ আবদুল হাই। তার বাবা ছিলেন ইপিসিএস (ইস্ট পাকিস্তান সিভিল সার্ভিস) অফিসার। তার পিতা গান গাইতেন আর কলেরগানে গান শুনতে পছন্দ করতেন। বাবার শখের গ্রামোফোন রেকর্ডের গান শুনে কৈশোরে তিনি সঙ্গীত অনুরাগী হয়ে উঠেন। ছোটবেলা থেকে গাইতে গাইতে গান শিখেছেন। তারপর আর থেমে থাকেননি। নিরন্তর গান করে খ্যাতির শীর্ষে অবস্থান নিয়েছেন। বর্তমানে তিনি বাংলাদেশের একজন প্রখ্যাত সঙ্গীত শিল্পী। বাংলা গানের অন্যতম প্রবাদ পুরুষ, জীবন্ত কিংবদন্তি এ শিল্পী। তার গাওয়া কালজয়ী অনেক দেশের গান শ্রোতাদের দেশপ্রেমে উজ্জীবিত করে। পঞ্চাশ বছরেরও বেশি সময় ধরে গান গাইছেন সৈয়দ আব্দুল হাদী।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় স্নাতকোত্তর ডিগ্রী লাভ করেছেন সৈয়দ আব্দুল হাদী। তিনি জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেছেন। বাংলাদেশ টেলিভিশনে প্রযোজক হিসেবেও তিনি কাজ করেছেন। সর্বশেষে তিনি লন্ডনে ওয়েল্স ইউনিভার্সিটিতে প্রিন্সিপাল লাইব্রেরীয়ান হিসেবে কাজ করেছেন।
১৯৫৮ সালে সৈয়দ আবদুল হাদী ভর্তি হলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে। ১৯৬০ সালে ছাত্রজীবন থেকেই চলচ্চিত্রে গান গাওয়া শুরু করেন সৈয়দ আবদুল হাদী। তখনকার সিনেমায় প্লেব্যাক মানেই ছিল উর্দু ছবিতে গান গাওয়া। তবে ১৯৬৪ সালে সৈয়দ আবদুল হাদী একক কণ্ঠে প্রথম বাংলা সিনেমায় গান করেন। সিনেমার নাম ছিল ‘ডাকবাবু’। মো. মনিরুজ্জামানের রচনায় সঙ্গীত পরিচালক আলী হোসেনের সুরে একটি গানের মাধ্যমে সৈয়দ আবদুল হাদীর চলচ্চিত্রে যাত্রা শুরু। অসংখ্য জনপ্রিয় গানের নন্দিত কণ্ঠশিল্পী সৈয়দ আবদুল হাদী।
বেতারে গাওয়া তার প্রথম জনপ্রিয় গান ‘কিছু বলো/এই নির্জন প্রহরের কণাগুলো হৃদয়মাধুরী দিয়ে ভরে তোলো’ চমৎকার রোমান্টিক এ গানটি গেয়েছিলেন ১৯৬৪ সালে আবদুল আহাদের সুরে। সালাউদ্দিন জাকি পরিচালিত ঘুড্ডি চলচ্চিত্রের গানে সুর ও সংগীত পরিচালনা করেছিলেন লাকী আখ্ন্দ। এই ছবির খুব জনপ্রিয় গান ‘সখি চলনা/ সখি চলনা/ জলসা ঘরে এবার যাই’- গেয়েছেন সৈয়দ আবদুল হাদী।
চলচ্চিত্রের কণ্ঠশিল্পী হিসেবেই সৈয়দ আবদুল হাদীকে সবাই চেনেন-জানেন। এছাড়া তিনি রবীন্দ্রসংগীত গেয়েও শ্রোতাদের মুগ্ধ করেছেন। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সার্ধশত জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে প্রকাশিত হয় সৈয়দ আবদুল হাদীর প্রথম রবীন্দ্র সংগীতের একক অ্যালবাম ‘যখন ভাঙলো মিলন মেলা’।
সৈয়দ আবদুল হাদী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা নিয়ে অনার্স পড়ার সময় সুবল দাস, পি.সি গোমেজ, আবদুল আহাদ, আবদুল লতিফ প্রমুখ তাকে গান শেখার ক্ষেত্রে সহায়তা ও উৎসাহ জুগিয়েছেন। বিটিভির প্রথম চারজন প্রযোজকের মধ্যে একজন ছিলেন তিনি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলায় মাস্টার্স শেষ করে লন্ডনে ওয়েল্স ইউনিভার্সিটিতে প্রিন্সিপাল লাইব্রেরীয়ান হিসেবে অবসর নিয়েছেন সৈয়দ আবদুল হাদী।
পরপর পাঁচবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পান জীবন্ত কিংবদন্তি শিল্পী সৈয়দ আবদুল হাদী। এর মধ্যে রয়েছে – গোলাপী এখন ট্রেনে – ১৯৭৮, সুন্দরী – ১৯৭৯, কসাই – ১৯৮০, গরীবের বউ – ১৯৯০ এবং ক্ষমা ১৯৯২। তার গাওয়া উল্লেখযোগ্য গানের মধ্যে রয়েছে-
যেও না সাথী/ ও যেও না সাথী/ চলেছো একেলা কোথায়, চোক্ষের নজর এমনি কইরা/ একদিন ক্ষইয়া যাবে, চলে যায় যদি কেউ বাঁধন ছিঁড়ে/ কাঁদিস কেন মন, আমার বাবার কথা, কথা বলবো না বলেছি, তেল গেলে ফুরাইয়া/বাত্তি যায় নিভিয়া, বিধিরে তোর আদালতে, তোমার ঐ চোখের, আউল বাউল লালনের দেশে/মাইকেল জ্যাকশান আইলোরে, বিদ্যালয় মোদের বিদ্যালয়,
এ জীবনে তুমি ওগো এলে, জন্ম দিনে কান্দে শিশু, কে জানে কত দূরে, মনে প্রেমের বাত্তি জ্বলে/ বাতির নিচে অন্ধকার, পৃথীবি তো দুদিনের ই বাসা, সব কিছু মোর উজাড় করে, মন পুকুরে চাইলে, জানি তুমি চলে যাবে, জন্ম থেকে জ্বলছি মাগো/ আর কতদিন বল সইবো, এমনওতো প্রেম হয়/ যেনো চোখের জলে কথা কয়, সতী মায়ের সতী কন্যা, চোখ বুঝিলে দুনিয়া আন্ধার/কিসের বাড়ি কিসের ঘর/কিসের সংসার, যে মাটির বুকে ঘুমিয়ে আছে/লক্ষ মুক্তি সেনা, একবার যদি কেউ ভালোবাসতো / আমার নয়ন দুটি জলে ভাসতো,
আছেন আমার মোক্তার / আছেন আমার ব্যারিস্টার ইত্যাদি৷ আজ এই কালজয়ী কিংবদন্তি শিল্পী সৈয়দ আব্দুল হাদীর ৮১ তম জন্মদিন ৷
All rights reserved © 2020-2024 dainikparibarton.com
অনুমতি ব্যতিত এই সাইটের কোনো কিছু কপি করা কপিরাইট আইনে দণ্ডনীয়।