রবিবার, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ০৫:০৭ অপরাহ্ন
মামুন বিন সিরাজ
হিজরী সনের প্রথম মাস হচ্ছে মুহররম। যে মাসের দশম দিন অর্থাৎ ১০ তারিখ হচ্ছে ইয়াওমুল আশুরা। আক্ষরিক অর্থের দিক থেকে যে কোন মাসের দশ তারিখকে আশুরা বলা যায়। কিন্তু ইসলামী শরিয়তে কেবলমাত্র মুহাররম মাসের দশ তারিখকেই আশুরা বলা হয়। এই দিন বিভিন্ন কারণে স্বাতন্ত্রে ভাস্বর এক দিন। ইসলামে মুহররম মাসের ঐতিহাসিক গুরুত্বের বিভিন্ন কারণ রয়েছে। ইসলামের প্রাক-প্রাথমিক যুগেও মুহররম ঐতিহ্যপূর্ণ বরকতময় ও তাৎপর্যমণ্ডিত ছিল। এ মাসে অনেক নবী ও রাসূলগণ ঈমানের কঠিন পরিক্ষার মাধ্যমে মুক্তি ও নিষ্কৃতি পেয়েছিলেন। এই দিনে ইসলামের অনেক তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা সংঘটিত হয়েছে।
এ দিনে ঘটে যাওয়া ঐতিহাসিক কিছু ঘটনা:
হযরত আদম (আঃ) থেকে ৬১ হিজরীর মুহররম মাসের ১০ তারিখ পর্যন্ত লক্ষ করলে দেখা যায়, এই দিনে আল্লাহ পাক হযরত আদম (আঃ) এর তাওবা কবুল করেন। পৃথিবীর প্রথম হত্যাকান্ড হাবিল কাবিলের ঘটনাও এই দিনে সংঘটিত হয়েছে। হযরত নূহ (আঃ) মহাপ্লাবন শেষে যুদী পর্বতে অবতরণ করেন। হযরত ইব্রাহীম (আঃ) কে নমরুদের অগ্নিকান্ড থেকে মুক্ত করা হয়েছে। হযরত আইয়ুব (আঃ) কে কুষ্ঠরোগ থেকে মুক্ত করা হয়েছে। হযরত ইউসুফ (আঃ) তার পিতা ইয়াকুব (আঃ) এর সাথে সুদীর্ঘ ৪০ বছর পর সাক্ষাৎ লাভ করাসহ আরোও অনেক তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনাবলী এই দিনে সংঘটিত হয়েছে। বিশেষতঃ এ সমস্ত বিখ্যাত ঘটনাগুলো ম্লান করে ৬১ হিজরির এই দিনে কারবালার প্রান্তরের রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দৌহিত্র ইমাম হুসাইন (রা.) এর হৃদয়বিদারক শাহাদত নিঃসন্দেহে কিয়ামত অবধি নবীভক্ত উম্মতের জন্য বেদনাদায়ক স্মৃতি। হযরত হুসাইন (রা.) এর শাহাদাত সত্যান্বেষী মুসলমানের জন্য প্রেরণা ও চেতনার মশাল। তিনি যে সত্য প্রতিষ্ঠার প্রত্যয়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে জুলুম-দুঃশ্বাসনের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে গেছেন। সেটা মুসলিম উম্মাহর জন্য শিক্ষণীয়। এ ঘটনা মুসলমানদের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে হলেও সত্যের পথে সংগ্রাম করার চেতনায় উদ্ধুব্ধ করে।
আশুরার গুরুত্ব ও শিক্ষা: পবিত্র আশুরা সম্পর্কে হাদীস শরীফে উল্লেখ হয়েছে, হযরত আবূ হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, একদা রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইয়াহুদীদের কতিপয় এমন লোকের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন, যারা আশুরার দিনে রোযা রেখেছিল। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাদেরকে জিজ্ঞেস করলেন, এটা কিসের রোযা? উত্তরে তারা বলল! এই দিনে আল্লাহ পাক হযরত মূসা (আ.) ও বনী ইসরাঈলকে ডুবে যাওয়া থেকে উদ্ধার করেছিলেন। অন্য এক বর্ণনায় পাওয়া যায় ফিরআউনের নির্যাতন থেকে মুক্ত করেছিলেন। এবং ফিরআউনকে দল-বল সহ নিমজ্জিত করেছিলেন। আর এই দিনেই হযরত নূহ (আ.) এর কিশতী জূদী পর্বতে স্থির হয়েছিল। যার কারনে এই দিনে হযরত নূহ (আ.) ও হযরত মূসা (আ.) কৃতজ্ঞতাস্বরূপ রোযা রেখেছিলেন। তাই আমরাও এই দিনে রোযা রাখি। তখন রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, মূসা (আ.) এর অনুসরণের ব্যাপারে এবং এই দিনে রোযা রাখার ক্ষেত্রে আমি তোমাদের থেকে বেশী হক্বদার। অতঃপর রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম সেদিন (আশুরার দিন) রোযা রাখেন এবং সাহাবায়ে কিরামদের রোযা রাখতে আদেশ করেন। (বুখারী ও মুসলিম)।
বুখারী শরীফের বর্ণনা মতে, মহররম মাসের প্রথম ১০ দিন রোজা পালন করা পূর্ববর্তী উম্মতদের উপর ফরজ ছিল। বিশেষত আশুরার দিন পূর্ববর্তী উম্মতরা রোজা পালন করতেন। কিন্তু রামাদ্বানের রোজা ফরয হওয়ার পর এর বিধান রহিত হয়ে যায়। এর পর থেকে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আশুরার রোজা পালনের জন্য সাহাবায়ে কিরামদের আশুরার রোজা রাখার জন্য ত্যাগিদ দিতেন এবং নিজেও রাখতেন। আশুরার ফজিলত সম্পর্কে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, রামাদ্বানের রোজার পর সর্বোত্তম রোজা হলো মহররমের রোজা। (মিশকাত শরীফ)।
আশুরার রোজা রাখার ফজিলত সম্পর্কে হাদীস শরীফে উল্লেখ রয়েছে হযরত আব্দুল্লাহ বিন আব্বাস (রা.) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে রোজা রাখার জন্য এত অধিক আগ্রহী হতে দেখিনি যত দেখেছি এই আশুরার দিন এবং রমজান মাসের রোজার প্রতি। (বুখারি)।
আশুরার রোজার গুরুত্ব সম্পর্কে অন্য এক হাদীসে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, আশুরার রোজার ব্যাপারে আমি আশাবাদী, আল্লাহ তাআলা এর অসিলায় অতীতের এক বছরের গুনাহ মাফ করে দেবেন। (তিরমিযী)।
অন্য এক বর্ণনায় রয়েছে হযরত কাতাদাহ (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, কোনো ব্যক্তি আশুরার দিনে রোজা রাখলে আল্লাহ তায়ালা পূর্ণ এক বছরের গুনাহসমূহ ক্ষমা করে দেন।
রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আশুরার রোজাকে অনেক গুরুত্ব দিতেন। এ প্রসঙ্গে হযরত হাফসা (রা.) বলেন, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম চারটি কাজ কখনো ত্যাগ করেননি। তা হলো: ১. আশুরার রোজা, ২. জিলহজের প্রথম ৯ দিনের রোজা, ৩. আইয়ামে বিজের রোজা—অর্থাৎ প্রতি মাসের ১৩, ১৪ ও ১৫ তারিখের রোজা এবং ৪. ফজরের দুই রাকাত সুন্নাত নামায।
আশুরার মূল শিক্ষা হচ্ছে ধৈর্য্য ও ত্যাগের মহিমায় উদ্ভাসিত হওয়া। ইমাম হুসাইন (রা.) এর আর্দশে উজ্জীবিত হয়ে মানবতাবিরোধী অপরাধ থেকে বিরত থাকা। সত্য ও সুন্দরকে প্রতিষ্ঠিত করা।
ইসলাম ধর্মের মৌলিক বিধানগুলো মেনে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের অনুকরণে আশুরা উদযাপনে মুসলমানদের উচিত রোজা রাখা, ইবাদত বন্দেগিতে মগ্ন হওয়া। ইসলামের স্বার্থে ধৈর্যধারণ ও ত্যাগের জন্য প্রস্তুত থাকা। কবির ভাষায় বলা যায়, ফিরে এল আজ সেই মুহররম মাহিনা। ত্যাগ চাই, মর্সিয়া ক্রন্দন চাহি না।
All rights reserved © 2020-2024 dainikparibarton.com
অনুমতি ব্যতিত এই সাইটের কোনো কিছু কপি করা কপিরাইট আইনে দণ্ডনীয়।