বিটিআই জালিয়াতি
চীনের সেলসম্যান জনি ঢাকায় ‘মশা’ বিশেষজ্ঞঅনলাইন ডেস্কঃ
চলতি বছরের জানুয়ারিতে যুক্তরাষ্ট্রের মিয়ামি শহর ঘুরে মশা নিধনে বিজ্ঞানভিত্তিক ও আধুনিক প্রযুক্তি প্রয়োগের বিষয়ে জ্ঞান অর্জন করেন ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) কর্মকর্তারা। ওই সফর-পরবর্তী পরিকল্পনা অনুযায়ী মশার লার্ভা নিধনে জৈব কীটনাশক ব্যাসিলাস থুরিংয়েনসিস ইসরাইলেন্সিস (বিটিআই) নামে একটি ব্যাকটেরিয়া আমদানি করেছে সংস্থাটি। দায়িত্ব গ্রহণের তৃতীয় বর্ষপূর্তিতে ১৩ মে সংবাদ সম্মেলনে মেয়র আতিকুল ইসলাম জানিয়েছিলেন, আগামী দুই সপ্তাহের মধ্যে বিটিআই দেশে আসবে। সময় পেরোলেও তা আসেনি। এর কয়েক মাস পর ৭ আগস্ট গুলশান লেকে ছিটিয়ে এ কীটনাশক প্রয়োগের উদ্বোধন করেন মেয়র। এরপর থেকে মশার ওষুধ আমদানিতে ষোলো আনাই জালিয়াতি প্রকাশ্যে এসেছে। এ জালিয়াতি চক্রে নাম-পরিচয় গোপন করে রয়েছেন এক চীনা নাগরিক। ডিএনসিসি জানিয়েছিল, তিনি সিঙ্গাপুর থেকে আগত বিটিআই কীটনাশক বিশেষজ্ঞ লি শিয়াং। অনুসন্ধানে জানা গেছে, তার প্রকৃত নাম জনি লি।
চীনা এ নাগরিক সম্পর্কে জানা যায়, এর আগেও জনি লি দুবার বাংলাদেশে এসেছিলেন। ২০১৭ সালে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের এক অনুষ্ঠানে যোগ দিতে আসেন তিনি। ২০১৯ সালেও এক অনুষ্ঠানে এসেছিলেন তিনি। জনি লি মূলত ‘শানডং গানন এগ্রো’র সেলস ম্যানেজার। তার ঠিকানা চীনের হংকং শহরের ওয়ান চাই এলাকার ১৮ লুয়ার্ড সড়কের ১৬/এফ ওয়ান ক্যাপিটাল প্লেসের ইউনিট ডি।
আরও জানা যায়, ১১ এপ্রিল বিটিআই ব্যাকটেরিয়া কেনার বিজ্ঞপ্তি দেয় ডিএসসিসির রাজস্ব বিভাগ। যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশ, ভারত, থাইল্যান্ড বা সিঙ্গাপুর থেকে বিটিআই আনার শর্ত ছিল ঠিকাদারের। কিন্তু সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান মার্শাল এগ্রোভেট ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড দরপত্রের শর্ত ভঙ্গ করে চীন থেকে বিটিআই আমদানি করে। চীনের ‘শানডং গানন এগ্রোকেমিক্যাল কোম্পানি’ থেকে আনা পাঁচ টন বিটিআইয়ের চালান চট্টগ্রাম বন্দর থেকে ৩০ জুলাই ৫ লাখ ৩৮ হাজার টাকা শুল্ককর পরিশোধ করে খালাস নেয় প্রতিষ্ঠানটি। আমদানিমূল্য দেখানো হয় ৪৮ হাজার ৫০০ ডলার। ডিএনসিসি প্রতি কেজি বিটিআই কিনেছে ৩ হাজার ৩৮৫ টাকা করে। সে হিসাবে পাঁচ টনের দাম পড়েছে ১ কোটি ৬৯ লাখ ২৫ হাজার টাকা।বিটিআই প্রয়োগ উদ্বোধন অনুষ্ঠানে লি শিয়াংকে সিঙ্গাপুরের বেস্ট কেমিক্যালের বিক্রয় ব্যবস্থাপক ও বিটিআই বিশেষজ্ঞ বলে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয়। একই সঙ্গে জানানো হয়, লি শিয়াং বিটিআই বিষয়ে ডিএনসিসির কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পাঁচ দিন প্রশিক্ষণ দেবেন। কিন্তু বিটিআই রপ্তানির বিষয়টি উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান সিঙ্গাপুরের বেস্ট কেমিক্যাল কোম্পানি অস্বীকার করে। একই সঙ্গে লি শিয়াংও তাদের কোনো প্রতিনিধি নয় বলেও জানায়। বিষয়টি নিয়ে গণমাধ্যমে খবর প্রকাশিত হলে সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান মার্শাল এগ্রোভেটকে চিঠি দেয় ডিএনসিসি। সেই চিঠির জবাবে চীনের ‘শানডং গানন এগ্রো’ নামে একটি প্রতিষ্ঠানকে তৃতীয় পক্ষ হিসেবে সামনে আনে মার্শাল এগ্রোভেট। কিন্তু এর সঙ্গেও বেস্ট কেমিক্যালের কোনো ব্যবসায়িক সম্পর্ক নেই বলে সিঙ্গাপুরের প্রতিষ্ঠানটি নিশ্চিত করে। একই সঙ্গে তারা জোর দিয়ে এটিও বলেছে, ‘আমরা কারও কাছে পাঁচ টন বিটিআই বিক্রি করিনি। সুতরাং এই পাঁচ টন বিটিআই কোনোভাবেই বেস্ট কেমিক্যাল সরবরাহ করেনি।’
ডিএনসিসির মেয়র আতিকুল ইসলাম বরাবর মার্শাল এগ্রোভেটেন লেখা চিঠিতে বলা হয়েছে, লি শিয়াং চীনা প্রতিষ্ঠান শানডং গানন এগ্রোকেমিক্যালের কর্মী। তিনি বেস্ট কেমিক্যাল থেকে বিটিআই আমদানি করতে তৃতীয় পক্ষ হিসেবে কাজ করেছেন। লি শিয়াং তৃতীয় পক্ষ হিসেবে আমাদের জানান যে, বেস্ট কেমিক্যাল কোম্পানি থেকে তিনি বিটিআই সংগ্রহ করে সরবরাহ করতে পারবেন। তারা লেটার অব অথরিটি দেন এবং আমরা ই-জিপির দরপত্রে অংশ নেই। কার্যাদেশ পাওয়ার পর লি শিয়াংয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করি এবং তিনি তার কোম্পানির মাধ্যমে বিটিআই সরবরাহ করেন।
ঢাকা উত্তর সিটির স্বাস্থ্য বিভাগের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, স্বাস্থ্য বিভাগ ব্যবহারকারী পর্যায়ের। আমদানি হয়েছে ভান্ডার ও ক্রয় শাখা থেকে। তারাই ওই ব্যক্তিকে আমাদের কাছে সিঙ্গাপুরের ওই কোম্পানির কর্মী এবং বিটিআই বিশেষজ্ঞ হিসেবে পরিচয় করিয়ে দিয়েছে। তারাই এর ব্যাখ্যা দিতে পারবে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের পরিচালক আব্দুল মাজেদ ২০২২ সালের ৩০ জুলাই অবসর-পরবর্তী ছুটিতে যান। অথচ বিটিআই আমদানিতে মার্শাল এগ্রোভেট যে লাইসেন্স জমা দিয়েছে, সেখানে ২০২২ সালের ১০ অক্টোবর ওই কর্মকর্তার স্বাক্ষর রয়েছে। তা ছাড়া মার্শাল এগ্রোভেটের পক্ষ থেকে জমা দেওয়া লাইসেন্সের নানা অসঙ্গতি পাওয়ার অভিযোগে প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তা ও স্থানীয় এজেন্টদের বিরুদ্ধে মামলা করেছে চট্টগ্রাম কাস্টম কর্তৃপক্ষ।
ডিএনসিসির মেয়র আতিকুল ইসলামের নির্দেশে বিটিআই জালিয়াতির ঘটনায় দরপত্র মূল্যায়ন কমিটিতে থাকা তিন কর্মকর্তাকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দিয়েছে সংস্থাটি। এই তিন কর্মকর্তা হলেন ডিএনসিসির সাবেক প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা জোবায়দুর রহমান, প্রধান ভান্ডার ও ক্রয় কর্মকর্তা রামেন্দ্রনাথ বিশ্বাস এবং সহকারী ভান্ডার ও ক্রয় কর্মকর্তা রাহাত আল ফয়সাল।
শোকজপ্রাপ্ত কর্মকর্তা রাহাত আল ফয়সাল বাদী হয়ে ২১ আগস্ট গুলশান থানায় করা প্রতারণার মমলায় চীনা নাগরিক লি শিয়াং ছাড়াও সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান মার্শাল এগ্রোভেট কেমিকেল ইন্ডাস্ট্রিজের তিনজনকে আসামি করা হয়েছে। তারা হলেন, প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আলী, ব্যবস্থাপনা পরিচালক আলাউদ্দিন ও নির্বাহী পরিচালক নাসির উদ্দিন আহমেদ।
ডিএনসিসির আইনজীবী সাজেদ আহমেদ বলেন, লি শিয়াং নিজেকে সিঙ্গাপুরের বেস্ট কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ প্রাইভেট লিমিটেড কোম্পানির প্রতিনিধি হিসেবে পরিচয় দিয়েছেন। কিন্তু বেস্ট কেমিক্যাল কোম্পানি আমাদের লিখিতভাবে জানিয়েছে, তিনি বেস্ট কেমিক্যালের কেউ নন। এ জন্য তাকেও আসামি করেছেন। তিনি এই মামলার চার নম্বর আসামি।
গুলশান থানার পুলিশ পরিদর্শক (তদন্ত) শেখ শাহানূর রহমান কালবেলাকে জানান, ‘ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের দায়ের করা মামলার তদন্ত চলছে। চার আসামির মধ্যে তিনজন হাইকোর্ট থেকে জামিনে নিয়েছে। মামলার চার নম্বর আসামি চীনা নাগরিক সম্পর্কে এখনো বিস্তারিত জানা যায়নি। তার খোঁজে অনুসন্ধান চলছে।’ চীনা নাগরিক দেশে আছেন কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘তার পাসপোর্ট নম্বর না পাওয়ায় তিনি দেশে আছেন নাকি চলে গেছেন তা নিশ্চিতভাবে জানা যায়নি।’
মার্শাল এগ্রোভেটের নির্বাহী পরিচালক নাসির উদ্দিন আহমেদের মোবাইল ফোনে একাধিকবার কল ও এসএমএস দিয়েও কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি। ডিএনসিসির প্রধান ভান্ডার ও ক্রয় কর্মকর্তা রমেন্দ্র নাথ বিশ্বাসের বক্তব্য জানতে যোগাযোগ করা হলে তিনি সংস্থাটির জনসংযোগ কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দেন।
বিটিআই নিয়ে জালিয়াতির অভিযোগ ওঠার ছয় দিন পর ১৯ আগস্ট তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করে ডিএনসিসি। ১০ দিনের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন দেওয়ার নির্দেশ দেয়া হলেও তদন্ত কমিটি এখনো তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয়নি। সংস্থাটির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা সেলিম রেজা বলেন, ‘আমাদের তদন্ত এখনো শেষ হয়নি। সময় বাড়াতে আবেদন করেছেন তদন্তকারী কর্মকর্তারা।’ চীনা নাগরিকের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘তার বিষয়েও তদন্ত চলছে। তদন্ত প্রতিবেদন হাতে পেলে বলতে পারব।’
সিঙ্গাপুরের বেস্ট কেমিক্যালের সঙ্গে ই-মেইলে যোগাযোগ করলে প্রতিষ্ঠানটি জানায়, শিগগিরই বেস্ট কেমিক্যাল আইনি পদক্ষেপ নেবে। এই প্রতারণা বেস্ট কেমিক্যালের গ্রাহকদের আর্থিক ক্ষতির পাশাপাশি ব্যবসায়িক সুনাম ক্ষুণ্ন করেছে।
নিউজ রুমঃ [email protected] অথবা [email protected]
মোবাইল: +8809696195106 অথবা +8801715-395106
All rights reserved © 2020-2024 dainikparibarton.com