রবিবার, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ০৪:৫৫ পূর্বাহ্ন
ভাস্কর সরকার (রা.বি),প্রতিনিধিঃ
আজ ২৩ জুন পলাশীর যুদ্ধের মাধ্যমে বাংলার স্বাধীনতা খর্বের কালো অধ্যায়ের সূচনা হয়েছিলো৷ শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌলার সাথে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির পলাশী নামক স্থানে যে যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিলো তাই পলাশীর যুদ্ধ নামে পরিচিত। ১৭৫৭ সালের জুনের ২৩ তারিখে এই যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এই যুদ্ধে সিরাজউদ্দৌলা পরাজিত হন এবং সমগ্র ভারতবর্ষে ইংরেজ শাসন প্রতিষ্ঠার পথ সূচিত হয়। নবাব সিরাজউদ্দৌলার পরাজয়ে বাংলার স্বাধীনতা যেমন নস্যাৎ হয় তেমনি মুসলিম শাসনেরও সমাপ্তি ঘটে ৷
পলাশী যুদ্ধের সূত্রপাত ঘটে ব্রিটিশ ও দেশীয় দালালদের চক্রান্তের মধ্যদিয়ে৷ ১৭৫৭ সালের ১২ জুন কলকাতার ইংরেজ সৈন্যরা চন্দননগরের সেনাবাহিনীর সঙ্গে মিলিত হয়। সেখানে দুর্গ রক্ষার জন্য অল্প কিছু সৈন্য রেখে তারা ১৩ জন অবশিষ্ট সৈন্য নিয়ে যুদ্ধযাত্রা শুরু করে। কলকাতা থেকে মুর্শিদাবাদের পথে হুগলী, কাটোয়ার দুর্গ, অগ্রদ্বীপ ও পলাশীতে নবাবের সৈন্য থাকা সত্ত্বেও তারা কেউ ইংরেজদের পথ রোধ করে নি। ফলে নবাব সিরাজউদ্দৌলা বুঝতে পারেন, তার সেনাপতিরাও এই ষড়যন্ত্রে শামিল।
বিদ্রোহের আভাস পেয়ে সিরাজ মীর জাফরকে বন্দি করার চিন্তা পরিত্যাগ করেন। তিনি মীর জাফরকে ক্ষমা করে তাকে শপথ নিতে বলেন। মীর জাফর পবিত্র কুরআন স্পর্শ করে অঙ্গীকার করেন যে, তিনি শরীরের একবিন্দু রক্ত থাকতেও বাংলার স্বাধীনতাকে ক্ষুণ্ন হতে দেবেন না। গৃহবিবাদের মীমাংসা করে নবাব রায় দুর্লভ, ইয়ার লুৎফ খান, মীর জাফর, মীর মদন, মোহন লাল ও ফরাসি সেনাপতি সিনফ্রেঁকে সৈন্য চালানোর দায়িত্ব দিয়ে তাদের সঙ্গে যুদ্ধযাত্রা করেন।
১৭৫৭ সালের ২৩ জুন সকাল প্রায় ৮টার দিকে যুদ্ধ শুরু হয়। ইংরেজদের বাহিনীর তুলনায় নবাবের বাহিনীর আকার অনেক বড় হলেও মীরজাফর, ইয়ার লতিফ এবং রায় দুর্লভের অধীনস্থ প্রায় দুই তৃতীয়াংশ সৈন্য নিষ্ক্রিয় দাঁড়িয়ে থাকে। মীরমদন, মোহনলাল, খাজা আব্দুল হাদী খান, নবে সিং হাজারীর নেতৃত্বাধীন সৈন্যরা এবং ফরাসী সৈনিকদের একটি দল যুদ্ধ চালিয়ে যায়। ক্লাইভ যুদ্ধে ধারণার চেয়ে বেশি প্রতিরোধের সন্মুখীন হন। যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে বৃষ্টিতে নবাব এবং ফরাসীদের কামানের গোলায় ব্যবহৃত গানপাউডার ভিজে ব্যবহারের অযোগ্য হয়ে পড়ে। কিন্তু ইংরেজরা তাদের গান পাউডার সুরক্ষিত রাখতে সক্ষম হয়। জানা যায়, ক্লাইভ দিনে যুদ্ধ চালিয়ে রাতে পালিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা করেছিলেন। কিন্তু যুদ্ধের এক পর্যায়ে বেলা তিনটার দিকে কামানের গোলার আঘাতে মীরমদন নিহত হলে নবাব ভেঙে পড়েন এবং মীর জাফরের কাছে পরামর্শ চান। মীরজাফর নবাবকে যুদ্ধ বন্ধ করে পরবর্তী দিনে নতুন উদ্যমে যুদ্ধ করার পরামর্শ দেন।
ওদিকে মোহনলালের প্রবল আপত্তি সত্ত্বেও নবাব যুদ্ধ বন্ধের নির্দেশ দেন। নবাবের সৈন্যরা পিছু হটে আসে। মীরজাফরের বার্তা পেয়ে ইংরেজরা নবাবের অপ্রস্তুত বাহিনীর ওপর হামলা চালায় এবং যুদ্ধে জয়লাভ করে। ফলে প্রায় ২০০ বছরের জন্য বাংলা স্বাধীনতা হারায়। প্রতি বছর সে জন্য ২৩ জুন পলাশী দিবস হিসাবে পালিত হয়। ১৭৫৭ সালের এইদিনে পলাশী প্রান্তরে রবার্ট ক্লাইভ, মীরজাফর, রায়দুর্লভ, ইয়ার লতিফ চক্র এই কালো দিবসের জন্ম দেয়। ঘৃণিত কলঙ্কজনক এই প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের অধ্যায় সৃষ্টির পেছনে জড়িত ছিল বিশ্বাসঘাতক জগৎশেঠ, মাহতাব চাঁদ, উমিচাঁদ, মহারাজা স্বরূপচাঁদ, মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র, রায়দুর্লভ, মীর জাফর, ঘষেটি বেগম, রাজা রাজবল্লভ, নন্দকুমার প্রমুখ কৌশলী চক্র। এই স্বার্থান্বেষী ষড়যন্ত্রীদের প্রথম শিকার ছিলো স্বাধীন ভারতের শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌল্লা এবং তার বিশ্বস্ত সেনাপতি মীরমদন ও প্রধান আমাত্য মোহনলাল কাশ্মিরী।
মূলত ২৩ জুন পলাশীর প্রান্তরে নবাব সিরাজউদ্দৌল্লা ও লর্ড ক্লাইভের মধ্যে এক যুদ্ধ নাটক মঞ্চায়িত হয়েছিলো। এতে নবাব বাহিনীর পক্ষে সৈন্যসংখ্যা ছিল প্রায় ৬৫ হাজার এবং ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির পক্ষে ছিল মাত্র ৩ হাজার। যুদ্ধের ময়দানে নবাব সিরাজউদ্দৌল্লার প্রধান সেনাপতি মীরজাফর ও তার অনুসারী প্রায় ৪৫ হাজার সৈন্য নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করে। ফলে যুদ্ধে স্বাধীনতার স্বপক্ষ শক্তির পরাজয় অনিবার্য হয়ে দাঁড়ায়। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি তাদের সেবাদাসদের সাহায্যে এভাবেই বাংলায় আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়। এরপর সাম্রাজ্যবাদী শক্তি যুদ্ধাপরাধী রাজাকাররা দীর্ঘ ১৯০ বছর এদেশে শাসন শোষণ করে। কোটি কোটি টাকার অর্থ সম্পদ ইংল্যান্ডে পাচার করে। বাংলাদেশ থেকে লুটকৃত পুঁজির সাহায্যে ইংল্যান্ডে শিল্প বিপ্লব ঘটে। আর এককালের প্রাচ্যের স্বর্গ সোনার বাংলা পরিণত হয় শ্মশান বাংলায়, স্থান পায় বিশ্বের দরিদ্রতম দেশ হিসেবে।
এ যুদ্ধের রাজনৈতিক ফলাফল ছিল ধ্বংসাত্মক ও সুদূরপ্রসারী। এ যুদ্ধে জয়ের মাধ্যমে ধীরে ধীরে বাংলা ব্রিটিশদের অধিকারে চলে আসে। বাংলা অধিকারের পর ক্রমান্বয়ে ব্রিটিশরা পুরো ভারতবর্ষ এমনকি এশিয়ার অন্যান্য অংশও নিজেদের দখলে নিয়ে আসে। পলাশীর যুদ্ধের এই নৃশংস ও কলঙ্কজনক ঘটনার মাধ্যমে কলকাতা কেন্দ্রিক একটি নতুন উঠতি পুঁজিপতি শ্রেণী ও রাজনৈতিক শক্তির উত্থান ঘটে। ইংরেজ ও তাদের এ দেশীয় দালালগোষ্ঠী দেশবাসীর ওপর একের পর এক আগ্রাসন চালায়। ফলে দেশীয় কৃষ্টি-সংস্কৃতি ও সামাজিক জীবনে ব্যাপক বিপর্যয় নেমে আসে। তাই ঐতিহাসিক পরিক্রমায় পলাশীর যুদ্ধকে গুরুত্বের দিক থেকে পৃথিবীর সেরা যুদ্ধগুলোর অন্যতম মনে করা হয়।
ভাস্কর সরকার
পিএইচ.ডি গবেষক
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।
All rights reserved © 2020-2024 dainikparibarton.com
অনুমতি ব্যতিত এই সাইটের কোনো কিছু কপি করা কপিরাইট আইনে দণ্ডনীয়।