আবু সায়েম মোহাম্মদ সা'-আদাত উল করীম:
জামালপুরের যুদ্ধাহত প্রয়াত বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল কুদ্দুসের পরিবার সুদীর্ঘ ৩৯ বছর পর ফিরে পেলেন। ১৭ এপ্রিল বুধবার জেলা প্রশাসনের সহকারী কমিশনার ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট গাজী আশিক বাহারের নেতৃত্বে সদর থানা পুলিশ, মুক্তিযোদ্ধা,স্থানীয় এলাকাবাসীসহ অন লাইন, প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক্স মিডিয়ার সাংবাদিকদের উপস্থিতিতে বুধবার ওই জমির দখল বুঝিয়ে দেওয়ার পাশাপাশি ওই জমির অবৈধ দখলদারদের একটি তিন তলা ও একটি চার তলা মোট দুটি বহুতল ভবন ভেঙে দিয়েছে।
যুদ্ধাহত প্রয়াত বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল কুদ্দুস এর জেষ্ঠ্য পুত্র খাজা ওয়াসিউল্লাহ বাবু জানান, ১৯৭৯ সালে মৃত উজির আলী সরদারের স্ত্রী হালিমা খাতুনের কাছ থেকে জামালপুর পৌর এলাকার সাহাপুর মৌজার দক্ষিণ মুকন্দবাড়ি এলাকায় ১৪ দশমিক ২৫ শতাংশ জমি তার পিতা বায়না দলিল মূলে কিনেন। মৃত উজির আলীর সন্তানাদি নাবালক থাকায় উজির আলীর স্ত্রী অভিভাবকত্বের আবেদন করেন। অভিভাবকত্বের আবেদন মঞ্জুর হলে বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল কুদ্দুস ভূমির মালিককে জমিটুকু সাব-কবলা দলিল করে দেয়ার অনুরোধ করেন।
ভূমির মালিক নানা তালবাহানা করতে থাকলে বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল কুদ্দুস আদালতে চুক্তি প্রবলের মামলা দায়ের করেন। এই সময়ের মধ্যে জনৈক মাহাবুবুল হক ওই জমির মালিকের সাথে যোগসাজশ করে মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল কুদ্দুসের বায়না দলিলের পূর্বের তারিখ দেখিয়ে একটি জাল বায়না দলিল তৈরি করেন। পরবর্তীতে ওই জাল দলিলের বিষয়টি আদালতে ভুয়া প্রমাণিত হলে ১৯৯২ সালের ৫ অক্টোবর জামালপুর সাব জজ আদালত মামলার বাদী বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল কুদ্দুসের পক্ষে রায় দেন। একই সঙ্গে আদালত পণ মূল্যের বিক্রির টাকা জমা দেওয়ার জন্য নির্দেশসহ বায়না সংশ্লিষ্ট তফসিল ভূমি আদালত থেকে রেজিস্ট্রেশন করে দেওয়ার নির্দেশ দেন।
প্রতিপক্ষ মাহাবুবুল হক ও তার লোকজনরা ১৯৯৯ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর আপিল আদালতে জেলা জজ কোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে হাইকোর্ট ডিভিশনে ১০৬৩/২০০০ ও ১০৬৪/২০০০ নং সিভিল রিভিশন দায়ের করেন। হাইকোর্ট ২০১১ সালের ২৪ মার্চ মাহাবুবুল হক ও তার লোকজনের পক্ষে রায় দেন। হাইকোর্ট ডিভিশনের রায়ের বিরুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধা আবুল কুদ্দুস সুপ্রিম কোর্ট ডিভিশনের আপিলেট ডিভিশনে লিভ টু আপিল এবং স্থীতি অবস্থার আবেদন করলে সুপ্রিম কোর্ট তার আবেদন গ্রহণ করে সকল পক্ষকে স্থিতি অবস্থা বিরাজ করার নির্দেশ দেন। হাইকোর্টের রায়ের সুবাদে মাহাবুবুল হক স্থানীয় আওয়ামী লীগের এক প্রভাবশালী নেতাসহ কতিপয় ব্যক্তি কাছে অত্যন্ত চতুরতার সঙ্গে নালিশি ভূমি বিক্রি করে স্বপরিবারে রাতের আঁধারে জামালপুর ত্যাগ করেন।
এরপর সেখানে ঐ প্রভাবশালী ভূমিদস্যু নেতার ছত্রছায়ায় রাতারাতি মাটি ভরাট করে দুটি বহুতল ভবন নির্মাণ করা হয়। এ অবস্থায় বীর মুক্তিযোদ্ধা আবুল কুদ্দুস সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশনার কপিসহ সদর থানায় সাধারণ ডায়েরি করলে সদর থানা পুলিশ তদন্ত করে প্রতিবেদন দেন।
সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশনা অবজ্ঞা করে জমি দখল করে বহুতল ভবন নির্মাণ করায় এ বিষয়ে শুনানি শেষে মাহাবুবুল হক ও তার লোকজনদের বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার অভিযোগ আনেন। দীর্ঘদিন মামলা চলাকালে অবশেষে সুপ্রিম কোর্ট উভয় পক্ষের শুনানি শেষে ২০২১ সালের ৪ অক্টোবর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল কুদ্দুসের পক্ষে রায় দেন। একই সাথে মামলা চলমান অবস্থায় সমস্ত দলিল বাতিল করে আদালত বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল কুদ্দুসকে জমির দখল বুঝিয়ে দেওয়ার নির্দেশনা দেন।
এরপর যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল কুদ্দুস বিগত ২০২২ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি ৮৫ বছর বয়সে স্ত্রী রহিমা বেগম এবং দুই পুত্র রেখে মারা যান। উচ্চ আদালতের আদেশ বাস্তবায়নের লক্ষ্যে জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট গাজী আশিক বাহার ১৭ এপ্রিল বুধবার সকালে ওই জমিতে যান এবং স্থানীয়দের উপস্থিতিতে পুনরায় জমি মেপে জমির মালিক প্রয়াত মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল কুদ্দুসের স্ত্রী রহিমা বেগম ও জ্যেষ্ঠ ছেলে খাজা ওয়াছিউল্লাহ বাবুকে জমি বুঝিয়ে দিয়ে সীমানায় লাশ নিশান উড়িয়ে দেন। নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের নির্দেশে ওই জমিতে দুটি বহুতল ভবনের মালিক ও তাদের ভাড়াটেরা তাদের আসবাবপত্র নিয়ে ভবন ত্যাগ করেন। এরপর সেখানে উচ্ছেদ অভিযান শুরু করা হয়।
বুধবার বিকেল পর্যন্ত দুটি বহুতল ভবনের নিচতলা ভেকু মেশিন দিয়ে ভেঙে দেওয়া হয়। উচ্ছেদ অভিযান চলাকালে জামালপুর সদর থানার ওসি মুহাম্মদ মহব্বত কবীরের নেতৃত্বে একদল পুলিশ, জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক কমাণ্ডার সুজাত আলী ফকিরের নেতৃত্বে দুই শতাধিক বীর মুক্তিযোদ্ধাসহ বিভিন্ন গণমাধ্যমের সাংবাদিক ও স্থানীয় গণমান্য ব্যক্তিবর্গ উপস্থিত ছিলেন। উচ্ছেদ অভিযান শেষে সন্ধ্যা ৭ টা ৩০ মিনিটে বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল কুদ্দুছ এর স্ত্রী ও দুই পুত্রের কাছে জমির দখল বুঝিয়ে দেন।
সুদীর্ঘ ৩৯ বছর পর নিজেদের জমি ফিরে পেয়ে প্রয়াত বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল কুদ্দুসের জ্যেষ্ঠ পুত্র খাজা ওয়াছিউল্লাহ্ উচ্চ আদালতের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে বলেন, আজকে আমার বাবা বেঁচে থাকলে দেখতে পেতেন যে আমরা ন্যায় বিচারের মাধ্যমে আমাদের জমি ফিরে পেয়েছি।
নিউজ রুমঃ [email protected] অথবা [email protected]
মোবাইল: +8809696195106 অথবা +8801715-395106
All rights reserved © 2020-2024 dainikparibarton.com