নভেল করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব সারা বিশ্বে একটি প্রলয় সৃষ্টি করেছে। এর কারণে মানবজাতি আক্রান্ত হওয়া ছাড়াও অর্থনীতির চাকা শ্লথ হওয়ার ফলে স্বাস্থ্যঝুঁকিসহ পুরো বিশ্ব এখন বেকারত্ব আর দারিদ্র্যের শঙ্কায় বিপর্যস্ত। করোনার এ অধ্যায় আমাদের মানবজীবন, সমাজ, রাষ্ট্র এবং সর্বোপরি গোটা বিশ্ব ব্যবস্থার ভেতর ও বাইরের রূপকে স্বচ্ছভাবে আমাদের সামনে উপস্থাপন করেছে। সকলের বোধোদয় হয়েছে যে, এতোদিনের ফুলে ফেঁপে ওঠা বিশ্বটা আসলে রোগাক্রান্ত প্রায়।
সামন্ততান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা ভেঙে ফরাসি বিপ্লব পরবর্তী সময়ের পরিক্রমায় পর্যায়ক্রমে শিল্পযুগ, এনলাইটেনমেন্ট এবং আধুনিকতাবাদের আবির্ভাবের ফলে বস্তুবাদী এক জগতকে আঁকড়ে ধরে পুরো পৃথিবী। আধুনিকতাবাদের সঙ্গে সঙ্গে বিজ্ঞানের অগ্রযাত্রা, ভোগবাদ এবং সর্বোপরি শিল্পের বিকাশের মাধ্যমে উত্থান ঘটে পুঁজিবাদের। উৎপাদনের মাত্রায় বর্তমান এককেন্দ্রিক পুঁজিবাদী বিশ্ব অর্থনীতিতে এসেছে বিশাল প্রবৃদ্ধি। কিন্তু সমস্যা রয়ে গেছে সম্পদের বণ্টন ব্যবস্থায়। তাইতো আজকের বিশ্ব আগের যে কোনো সময়ের চেয়ে বিপুল বিত্তের অধিকারী হলেও একইসঙ্গে সর্বগ্রাসী বঞ্চনা এবং নিদারুণ বৈষম্য প্রতিনিয়ত বেড়েই চলেছে।
মুক্তবাজার অর্থনীতির সমর্থক একটি পুঁজিবাদী রাষ্ট্র এমন এক ব্যবস্থা, যেখানে বাজার উদারীকরণ, ব্যক্তিমালিকানা উদ্বুদ্ধকরণ এবং রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ হ্রাসের মাধ্যমে স্বল্প সংখ্যক বড় বড় পুঁজিপতিদের হাতে ব্যাপক পুঁজি কেন্দ্রীভূত হয়। পুঁজির চরিত্র হচ্ছে বিনিয়োগ, বিনিয়োগ আর পুনঃবিনিয়োগ; চূড়ান্ত ফলাফল হচ্ছে মুনাফা। বিনিয়োগকৃত পুঁজি থেকে শ্রমিকদের উদ্বৃত্ত শ্রমের মাধ্যমে অতিরিক্ত মুনাফা আয় করে ধীরে ধীরে আরও মুনাফা অর্জিত হয়। বিশাল জনগোষ্ঠী সেই শিল্পে সস্তা শ্রম দিয়ে ‘ট্রিকেল ডাউন’ বা চুইয়ে পড়া পারিশ্রমিক নিয়ে যান্ত্রিক জীবনযাপনে বাধ্য হয়।
প্রখ্যাত তাত্ত্বিক মার্শাল ম্যাকলুহানের ‘গ্লোবাল ভিলেজ’ প্রত্যয় হতে উদ্ভূত আজকের ‘বিশ্বায়ন’ বা গ্লোবালাইজেশন মূলত একটি অর্থনৈতিক প্রপঞ্চ। এ শব্দটি মুক্তবাজার ব্যবস্থার সঙ্গে বেশি সম্পৃক্ত, যা বিশ্বকে দেখে পুঁজির দৃষ্টিতে। নব্বইয়ের দশকের ‘কোল্ড ওয়ার’ পরবর্তী সময়ে বিশ্বায়নের দাপটে এতদিন ধরে নিয়ন্ত্রিত অর্থনীতির নেপথ্যে ধীরে ধীরে ক্রিয়াশীল থেকে মুক্তবাজারের দিকে ঝুঁকে পড়ার প্রবণতাটি প্রকাশ্য হওয়ার সুযোগ পায়। পশ্চিমা বড় বড় বহুজাতিক কোম্পানির নেতৃত্বে পরিচালিত বিশ্বায়নের মূল কথা ব্যাপক অর্থনৈতিক শোষণের লক্ষ্যে নিজস্ব ব্যবসা ও পণ্যের বিশ্ববাজার দখলে রাখা। এ খেলায় তাদের জয়কে সুনিশ্চিত, নিরাপদ এবং দীর্ঘস্থায়ী করার জন্য তারা শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা, প্রশিক্ষণ, প্রযুক্তি, মেধা, বিজ্ঞান এমনকি মানুষকেও পণ্য করে তোলে। বর্তমান বিশ্ব ব্যবস্থায় পুঁজিবাদী বিশ্বায়নের চরম পর্যায় হিসেবে এটি বিদ্যাজাগতিক পরিসরে ‘নয়া উদারনৈতিক অর্থনীতি’ বা ‘নিও লিবারেল ইকোনোমি’ নামেই বেশি পরিচিত। ডেভিড সি. কর্টেন (১৯৯৬) দেখিয়েছেন, নিও লিবারেল ইকোনোমিতে বাজার অর্থনীতির প্রবৃদ্ধির মাধ্যমে উন্নয়ন ঘটলেও মুষ্টিমেয় কিছু ব্যক্তি এর সুফল ভোগ করে। তাছাড়া এ পদ্ধতি অধিক মুনাফার আশায় বিভিন্ন কৌশলে সাধারণ মানুষকে ভোগবাদী করে তোলে।
বিশ্বব্যাপী পুঁজিবাদকে চাঙ্গা রাখার জন্য তথাকথিত উন্নয়নের বুলি আউড়িয়ে প্রতিনিয়ত আমরা পৃথিবীব্যাপী পরিবেশ ও প্রকৃতিকে বিনষ্ট করে চলেছি। বিশ্বায়নকে গড়ে তোলা হয়েছে পুঁজি এবং মুনাফার স্বার্থে। ফলে বৈশ্বিক জনস্বাস্থ্য, প্রকৃতি ও পরিবেশকে আগ্রাহ্য করে কেবল পুঁজির স্বার্থ দেখার দীর্ঘ ঐতিহ্য এবার কেবল নৈতিকভাবেই নয়, কার্যকরিতার দিক থেকেও চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে।
আধুনিকতাবাদ ধরেই নিয়েছিল যে, বিজ্ঞান দিয়ে শান্তি, প্রগতি এবং সমৃদ্ধি অর্জনের মাধ্যমে মানব ও এ ধরণীর সব সমস্যাগুলোকে দূরীভূত করা সম্ভব। এর নামে পৃথিবীকে যে সুখের স্বর্গ বানানোর কথা তা আজ যুদ্ধ, ক্ষমতার লড়াই, বৈষম্য, ক্রোধ, হিংসা, মুনাফা, জুলুম, শোষণ, সন্ত্রাসবাদ, উগ্রতা এবং কর্তৃত্ববাদী শাসনের লড়াইয়ের এক অসুস্থ হাইব্রিড পৃথিবী বানানোর মাধ্যমে এক খণ্ড নরকে পরিণত করা হয়েছে। প্রকৃতি, পরিবেশ এবং মানুষের সহবস্থান ব্যতীত কোনো উন্নয়নই যে ফলপ্রসু হতে পারে না তা পুঁজিবাদী বিশ্বায়নের জন্য আজ সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।
ফলে বর্তমান পরিস্থিতি জানান দিচ্ছে যে, আকাঙ্খিত স্বপ্ন পূরণ করা থেকে আমরা যোজন যোজন দূরে অবস্থান করছি। কাজেই এতোদিন ধরে যে বিশ্বব্যবস্থা আমাদের সামনে আবির্ভূত হয়েছে তা অনেক দিক থেকে প্রশ্নবিদ্ধ এবং নানা রকম অসঙ্গতিতে পরিপূর্ণ। একদিকে পুঁজিবাদী রাষ্ট্রসমূহ সামাজিক খাতে (শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা ইত্যাদি) পর্যাপ্ত রাষ্ট্রীয় বিনিয়োগ না করে অনুৎপাদনশীল খাতে বিনিয়োগ বৃদ্ধি করেই চলেছে এবং সামাজিক খাতকে পর্যায়ক্রমে মুনাফা কেন্দ্রিক ব্যক্তিমালিকানায় ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। অন্যদিকে, বর্তমান বিশ্বব্যবস্থার ত্রুটিগুলোর অন্যতম মাত্রা হলো রাষ্ট্র সবকিছু তার সীমানা কেন্দ্রিক তথা রাষ্ট্রভিত্তিকভাবে বিবেচনা করে, অথচ মানুষের নিরাপত্তা এবং স্বাস্থ্য বৈশ্বিক ব্যবস্থার ভিত্তিতে হওয়া উচিৎ ছিল।
পুঁজিবাদের শ্রেষ্ঠত্ব- এর অর্থনৈতিক ব্যবস্থা বিশেষ করে সামাজিক ব্যবস্থা যে কতটা ভঙ্গুর তা ইতোমধ্যে প্রমাণিত হয়ে চ্যালেঞ্জের মধ্যে পড়েছে। নভেল করোনাভাইরাস এমনভাবে প্রবল পরাক্রমকে অসহায় অবস্থায় ঠেলে দিয়েছে এবং দুনিয়াকে থমকে যেতে বাধ্য করেছে যা এতদিন অন্যকিছুই পারেনি। বিশ্বের বেশিরভাগ অঞ্চলের মানুষের লকডাউনের ফলে করোনা সংকট যখন কেটে যাবে তখন হয়ত পৃথিবীর তাপমাত্রা কয়েক ডিগ্রি নেমে আসবে, যা এ যাবৎকাল জলবায়ু সংকট অস্বীকারকারীরা প্রত্যাখান করে এসেছিল। এটি পুঁজিবাদের এমন এক জায়গায় আঘাত হেনেছে যে, ২০০৮ সালের আর্থিক মন্দাকালের মতো বড় বড় কর্পোরেশন ও ব্যাংক বেইল আউট করারও খুব বেশি সুযোগ পাবে কিনা সন্দেহ। তাইতো করোনার বৈশ্বিক মহামারির ফলে বিশ্বব্যাপী একটা ভিন্ন সমাজের বিমূর্ত স্বপ্ন আরও প্রবলভাবে মূর্ত হয়ে উঠছে।
বর্তমান বিশ্ব ব্যবস্থায় মানুষে মানুষে বৈষম্য, ভোগবাদ, পরিবেশ বিনষ্টকারী, প্রকৃতি বিরুদ্ধ এক অসুখের নাম, কোভিড-১৯। বিশ্ব যেখানে বস্তুবাদী ভাবনা, রাষ্ট্রভিত্তিক কাঠামোয় গুরুত্ব, ব্যক্তিকেন্দ্রিক এবং মুনাফাকেন্দ্রিক চিন্তায় বিভোর সেখানে মানুষ, পরিবেশ, জনস্বাস্থ্য এবং মানুষের নিরাপত্তার কথা গৌণ রয়ে যেতে বাধ্য; ফলে অবহেলায় পর্যবসিত হয় সুন্দর ও বাসযোগ্য পৃথিবী গড়ে তোলার গুরুত্বপূর্ণ উপাদানগুলো। এ অবস্থাকে এখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ বলে মনে করা হচ্ছে।
করোনা পরবর্তী পৃথিবী কি প্রস্তুত হবে একটি জনবান্ধব, পরিবেশ-বান্ধব বৈশ্বিক পরিবেশ তৈরি করতে? বৈশ্বিক জনমনে তাইতো এখন প্রশ্ন উঠেছে যে, পৃথিবীটা যেভাবে চলছিল, সেভাবেই কী চলবে - না নতুন এক বিশ্ব ব্যবস্থার জন্ম হবে। যে ব্যবস্থা হবে কোনো নির্দিষ্ট দেশ নয়, কোনো নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠী নয়- সবার জন্য, সব মানুষের জন্য কল্যাণকর!
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে আটলান্টিকের দুপাড়ের কোটি কোটি মানুষ নিহত হওয়ার ফলে যুদ্ধ পরবর্তী সময়ে বিশ্ব শান্তির জন্য ওই অঞ্চলের মানুষের সম্মিলিত দাবির পরিপ্রেক্ষিতেই ১৯৪৫ সালে জাতিসংঘের জন্ম হয়েছিল। আর নভেল করোনা ভাইরাসে পৃথিবীব্যাপী সকল মানুষ কমবেশি ক্ষতিগ্রস্ত। করোনা উত্তর বিশ্ব ব্যবস্থার পরিবর্তন অবশ্যম্ভাবী হলেও এর বাস্তবায়ন হয়তো খুব সহজ হবে না। পুঁজিবাদ কি এতো সহজে দমে যাবে বা হাত গুটিয়ে বসে থাকবে? পুঁজিবাদের চরিত্রই হলো যেনতেনভাবে জোড়াতালি দিয়ে এর কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়া এবং সাময়িক বাধা অতিক্রম করা। কাজেই করোনা পরবর্তী বিশ্ব ব্যবস্থায় সামাজিক খাতে ‘কর্পোরেট সামাজিক দায়বদ্ধতা’ বা ‘সামাজিক ব্যবসা’র মতো নতুন কোনো অভিপ্রায় নিয়ে পুঁজিবাদের আবির্ভাব ঘটলে আশ্চর্য হওয়ার মোটেই কোনো কারণ থাকবে না।
অতএব, নভেল করোনাযুদ্ধ পরবর্তী পৃথিবী কেমন হবে তা এখনই অনুমান করা কঠিন। একমাত্র সময়ই বলে দেবে যে, করোনা উত্তর বিশ্ব ব্যবস্থায় পুঁজিবাদের পতন হবে, নাকি আরও শক্তিশালীরূপে আবির্ভূত হয়ে পুনরায় বিশ্ব ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণ করবে।
লেখক: পোস্ট ডক্টরাল রিসার্চ ফেলো, এশিয়ান ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি, থাইল্যান্ড
নিউজ রুমঃ [email protected] অথবা [email protected]
মোবাইল: +8809696195106 অথবা +8801715-395106
All rights reserved © 2020-2024 dainikparibarton.com