শুক্রবার, ২২ নভেম্বর ২০২৪, ০২:০৩ অপরাহ্ন
ড
বর্তমানে ইউনানী- আয়ুর্বেদিক চিকিৎসার পথ প্রদর্শক হিসেবে আগ্রণী ভূমিকা পালনকারী এক মহান কিংবদন্তি সর্ব মহলে পরিচিত মুখ হামদর্দের ইউছুফ হারুন ভূঁইয়া। ইউনানী-আয়ুর্বেদিক জগতের ব্যক্তিবর্গ তাঁকে এম.ডি স্যার নামে সম্বোধন করে থাকেন।
জন্ম ও বংশ পরিচয়ঃ- এই মানুষটি লক্ষ্মীপুর জেলার দত্তপাড়া গ্রামের সম্ভ্রান্ত ভূঁইয়া পরিবারে ১৯৫৩ সালের ১ মার্চ জন্ম গ্রহণ করেন। তিন ভাই ও চার বোনের মধ্যে তিনি দ্বিতীয়। তাঁর পিতা জনাব ছায়েদ উল্লাহ ভূঁইয়া ছিলেন একজন বুদ্ধিদীপ্ত, দূরদৃষ্টিসম্পন্ন, ধর্মপ্রাণ আদর্শ মানুষ। অর্থের মোহ তাঁকে কখনো আদর্শ থেকে বিচ্যুত করতে পারেনি। ১৯৮৫ সালের ১ জানুয়ারি তাঁর সম্মানিত পিতা ইহলোক ত্যাগ করেন৷
মা রওশন জাহান ছিলেন একজন বিদূষী, সমব্যথি পরোপকারী, সাহায্যকারী, দানশীল, পর্দানশীন, নেককার ভালো মনের মানুষ। গ্রামের সাধারণ মহিলারা সমস্যায় পড়লেই ছুটে যেত তাঁর কাছে, তিনি কাউকে খালি হাতে ফিরিয়ে দিতেন না। এই মহীয়সী নারী ১৯৯৬ সালের ১৫ মার্চ ইহলোক ত্যাগ করেন। মায়ের এই গুণটি পূর্ণভাবে বিকশিত হয়েছে তাঁর মাঝে।
আলহাজ্ব আয়েশা সিদ্দিকা ৪৮ বছরের দীর্ঘ জীবন সঙ্গিনী হিসেবে তাঁকে নেপথ্যে থেকে ভালোবাসা ও শক্তি যুগিয়েছেন। এই মহিয়সী নারী ২০১৮ সালের ২৯ আগস্ট সকল প্রিয়জনকে কাঁদিয়ে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
কর্মব্যস্ত মানুষটির কর্মক্লান্তি দূর করার নিমিত্তে পরিবারের সদস্যদের অনুরোধে ২০১৯ সালের ২২ এপ্রিল তিনি হাকীম কামরুন্নাহার পলিনের সাথে দ্বিতীয় বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। পারিবারিক জীবনে তিনি তিন ছেলে ও দুই কন্যার জনক।
শিক্ষা জীবনঃ- ইউছুফ হারুন ভূঁইয়াকে একজন আদর্শ মানুষ তৈরি করতে পিতা-মাতা ছিলেন বদ্ধপরিকর। তাঁর শৈশব-কৈশোর কেটেছে গ্রামে। গাঁয়ের মানুষের সাধারণ জীবনের আড়ালে লুকিয়ে ছিল কষ্টের যন্ত্রণা। এ কষ্ট ছিল খাদ্যের অভাব এবং যাতায়াতের সুব্যবস্থা ও সুচিকিৎসার অভাব। চিকিৎসার অভাবে ধুঁকে ধুঁকে গ্রামের সাধারণ মানুষকে মরতে দেখে ব্যথিত হন তিনি। দেখেছেন হাতুড়ে ডাক্তারের ভুল চিকিৎসার নির্মম পরিণতি। ভাবতেন কিভাবে এঁদের ভাগ্যোন্নোয়ন করা যায়! তখন থেকেই মানুষকে এ যন্ত্রণা থেকে মুক্ত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। হৃদয়ে জন্ম নিয়েছিল প্রতিটি মানুষের দোরগোড়ায় চিকিৎসা সেবা পৌঁছানোর দৃঢ় অঙ্গীকার।
আর তাই তিনি ইউনানী চিকিৎসা বিজ্ঞানের জ্ঞানার্জনে ব্রতী হলেন। কঠোর পরিশ্রম আর সাধনার পর তিনি ইউনানী চিকিৎসা বিজ্ঞানে ডিপ্লোমা ইন ইউনানী মেডিসিন এন্ড সার্জারি (ডিইউএমএস) ডিগ্রী লাভ করেন। অতপর তিনি এম এম ডিগ্রী লাভ করেন। ড. হাকীম ইউছুফ হারুন যুক্তরাষ্ট্রের ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি থেকে ইন্টিগ্রেটেড মেডিসিনের উপর ‘ডক্টর অব মেডিসিন’ ডিগ্রি অর্জন করেন। তিনি ওয়ার্ল্ড এসোসিয়েশন অব ইন্টিগ্রেটেড মেডিসিনের ফেলো।
পেশা ও কর্মজীবনঃ- এম এম ডিগ্রী অর্জনের পর তিনি ১৯৭১ সালে পুলিশ বিভাগে অফিসার হিসাবে নিয়োগ প্রাপ্ত হয়ে তেজগাঁও থানায় কর্মজীবন শুরু করেন। এলাকায় তিনি হারুন দারোগা হিসাবে পরিচিত ছিলেন। মুক্তিযোদ্ধের সময় পাঞ্জাবীরা মুক্তিযোদ্ধাদের ধরে নিয়ে আসতো। তিনি পাঞ্জাবীদের সামনে তাদের লকারে ঢুকাতেন আর রাতের আঁধারে থানার পিছন দিক দিয়ে তাদের ছেড়ে দিয়ে বলতেন, “ঢাকার বাইরে অপারেশন করো, আবার ধরা পড়লে তোমরাও মরবে আমিও মরবো”। তিনি এভাবে অসংখ্য মুক্তিযোদ্ধাকে বাঁচিয়েছিলেন। জীবিত মুক্তিযোদ্ধারা আজও তাঁকে শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করে থাকেন।
(পর্ব-২)
হামদর্দে হাকীম মোঃ ইউছুফ হারুন ভূঁইয়াঃ- দেশ স্বাধীন হবার পর পশ্চিমাদের রেখে যাওয়া পরিত্যক্ত সম্পত্তি আত্মসাতের লোভ পরিত্যাগ করে, সরকারি চাকরি ছেড়ে তিনি হামদর্দের যোগ দিলেন। তিব্বিয়া হাবিবিয়া কলেজ থেকে ডিইউএমএস ডিগ্রী অর্জন করায় ইউনানী প্রতিষ্ঠানে যোগ দিতে তাঁর তেমন কোন সমস্যা হয়নি। কৈশরে মানুষের জন্য চিকিৎসা সেবা সহজতর করার যে স্বপ্ন জেগেছিল, হামদর্দে যোগ দেওয়ার পর তা বাস্তবায়নের পথ খুঁজে পেল। সারা দেশে গড়ে তুললেন অনেক গুলো চিকিৎসা কেন্দ্র। হামদর্দের নিজস্ব অভিজ্ঞ এবং যোগ্য চিকিৎসকগণ বিনা ফিতে ব্যবস্থাপত্র প্রদান করতে লাগলেন। কিন্তু তৎকালীন মুতাওয়াল্লিদের অলসতা, অনৈতিকতা এবং অর্থলোলুপতার কারণে হামদর্দের অবস্থা দিন দিন খারাপের দিকে যাচ্ছিল। হামদর্দের অব্যবস্থাপনা এবং লোকসান ঠেকানোর জন্য কর্তৃপক্ষ ১৯৭২ থেকে ১৯৭৭ পর্যন্ত পরপর ৭ জন মুতাওয়াল্লী পরিবর্তন করেছেন। ১৯৭৭ সালে জনাব নুরুল আবছারের কাঁধে মুতাওয়াল্লীর দায়িত্ব অর্পিত হয়। তিনি অসুস্থ থাকায় ড. হাকীম ইউসুফ হারুন ভূঁইয়ার কাঁধেই হামদর্দ এর সকল দায়-দায়িত্ব অর্পিত হয়। শুধু সই-স্বাক্ষরের দায়িত্ব রইল নুরুল আবছার সাহেবের কাঁধে। তখন হামদর্দের মূলধন ৫০,২২৫ টাকা। দায়-দেনা ২,৮২,০১৯ টাকা। বাকি বকেয়া করে ঔষধ তৈরীর কাজ চালিয়ে যেতে লাগলেন। যাতায়াতের কোন বাহন না থাকায়, কি আর করা ? একটি সাইকেল কিনে নিলেন, আর সাইকেল চালিয়ে সারতে লাগলেন ব্যবসায়িক যাবতীয় যোগাযোগ কর্মকান্ড।
অবশেষে ১৯৮২ সালে জনাব নুরুল আবছারের মৃত্যুর পর মুতাওয়াল্লি হিসাবে হাকীম মোহাম্মদ ইউসুফ হারুনকে সকল দায়িত্ব প্রদান করা হয়। আলহামদুলিল্লাহ, তিনি অক্লান্ত পরিশ্রম করে হামদর্দকে একটি বিশ্ব মানের প্রতিষ্ঠানে রূপান্তর করতে সক্ষম হন।
এক সময় এলোপ্যাথিক ডাক্তারগণ হারবাল ঔষধকে ঔষধ বলতে রাজি ছিলেন না। ড. ইউছুফ হারুন ভূঁইয়া ডাক্তারদের নিয়ে সেমিনার, সিম্পোজিয়াম এবং বিভিন্ন ওয়ার্কশপ করে তাদের হারবাল ঔষধের গুনাগুন এবং কার্যকারিতা বুঝিয়েছেন। এর ফলে এলোপ্যাথিক ডাক্তারদের মনে যে সন্দেহ আর অবিশ্বাস জন্ম নিয়েছিল তা দূর হয়ে যায়। ডাক্তারদের অনেকে এখন হামদর্দ এর ঔষধ শুধু রোগীকেই প্রেসক্রাইব করেন না নিজেরাও সেবন করেন।
All rights reserved © 2020-2024 dainikparibarton.com
অনুমতি ব্যতিত এই সাইটের কোনো কিছু কপি করা কপিরাইট আইনে দণ্ডনীয়।