সোমবার, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ০৪:৪১ পূর্বাহ্ন
নিউজ ডেস্কঃ
কোটা সংস্কারের দাবিতে শিক্ষার্থীদের ৩৬ দিনব্যাপী আন্দোলনে শেষ পর্যন্ত পদত্যাগ করেছেন ক্ষমতাসীন নেত্রী শেখ হাসিনা। সরকারি চাকরিতে কোটা প্রথা সংস্কারের দাবিতে দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের এবারের আন্দোলন ছিল দ্বিতীয় দফা আন্দোলন। ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে শুরু প্রথম দফার আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতীয় সংসদে কোটা বাতিলের ঘোষণা দেন। ওই বছরের ৪ অক্টোবর কোটা প্রথা বাতিল প্রসঙ্গে পরিপত্র জারি করে সরকার।
দ্বিতীয় দফা আন্দোলন শুরু হয়েছিল চলতি বছরের পয়লা জুলাই। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে কোটা বাতিলের পরিপত্র পুনর্বহালের দাবিতে ছাত্রসমাবেশ ও বিক্ষোভ অনুষ্ঠিত হয়। চলতি বছরের ৫ জুন সরকারি দপ্তর, স্বায়ত্তশাসিত ও আধাস্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান এবং বিভিন্ন করপোরেশনের চাকরিতে সরাসরি নিয়োগের ক্ষেত্রে (নবম থেকে ১৩তম গ্রেড) মুক্তিযোদ্ধা কোটা বাতিলের পরিপত্র অবৈধ ঘোষণা করে রায় দেন আদালত। এর পরদিন পরিপত্র বাতিলের প্রতিবাদে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ শিক্ষার্থীদের ব্যানারে বিক্ষোভ সমাবেশ করেন শিক্ষার্থীরা।
মূলত এ দিনেই কোটা সংস্কারের দাবিতে শিক্ষার্থীদের দ্বিতীয় দফা আন্দোলনের বীজ বপন হয়। কোটা সংস্কারের দাবিতে দীর্ঘ ৩৬ দিনের আন্দোলনে যা যা ঘটেছে তা থাকছে এই টাইমলাইনে :
৫ জুন ২০২৪, বুধবার
২০১৮ সালের ৪ অক্টোবর কোটা বাতিল করে জারি করা সরকারি পরিপত্র অবৈধ ঘোষণা করে রায় প্রদান করেন হাইকোর্ট। এতে সরকারি দপ্তর, স্বায়ত্তশাসিত ও আধাস্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান এবং বিভিন্ন করপোরেশনের নবম থেকে ১৩তম গ্রেডের সরকারি চাকরিতে মুক্তিযোদ্ধা কোটায় নিয়োগের ক্ষেত্রে আর বাধা থাকল না।
৬ জুন, বৃহস্পতিবার
হাইকোর্টের বাতিলকৃত পরিপত্র বাতিল করে দেওয়া রায় বাতিলের দাবিতে ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীবৃন্দ’-এর ব্যানারে বিক্ষোভ করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা।
তাঁরা সরকারি চাকরিতে মেধাভিত্তিক নিয়োগ বহাল রাখার দাবি জানান।
হাইকোর্টের বাতিলকৃত পরিপত্র বাতিল ও সরকারি চাকরিতে মেধাভিত্তিক নিয়োগ বহাল রাখার দাবি ছড়িয়ে পড়ে দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশাপাশি বিক্ষোভ সমাবেশ হয় চট্টগ্রাম ও বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়েও। শিক্ষার্থীরা তাঁদের দাবি মানতে সরকারকে ৩০ জুন পর্যন্ত সময় বেঁধে দেন। এই সময়ের মধ্যে দাবি পূরণ না হলে সর্বাত্মক আন্দোলনের ঘোষণা দেন তাঁরা।
১ জুলাই, সোমবার
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে কোটা বাতিলের পরিপত্র পুনর্বহালের দাবিতে ছাত্রসমাবেশ ও বিক্ষোভ অনুষ্ঠিত হয়। সমাবেশে ৪ জুলাইয়ের মধ্যে দাবির বিষয়ে চূড়ান্ত সুরাহার আহ্বান জানিয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পক্ষ থেকে তিন দিনের কর্মসূচির ঘোষণা দেওয়া হয়।
২ জুলাই, মঙ্গলবার
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে অনুষ্ঠিত হয় মিছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও অধিভুক্ত সাত কলেজ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়সহ রাজধানীর বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা যোগ দেয় মিছিলে। মিছিলটি নীলক্ষেত, সায়েন্স ল্যাবরেটরি ও বাটা সিগন্যাল মোড় ঘুরে শাহবাগে গিয়ে থামে। একই দিন বিকেলে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল শিক্ষার্থী ঢাকা-আরিচা মহাসড়ক ২০ মিনিটের জন্য অবরোধ করেন।
৩ জুলাই, বুধবার
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পূর্বঘোষিত কর্মসূচি অনুযায়ী ঢাকার শাহবাগ মোড়, ময়মনসিংহের কয়েকটি সড়ক ও রেললাইন, ঢাকা-আরিচা মহাসড়ক, চট্টগ্রাম-খাগড়াছড়ি মহাসড়ক এবং বরিশাল-কুয়াকাটা মহাসড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করে সংশ্লিষ্ট এলাকার বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা। আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ও বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ে।
৪ জুলাই, বৃহস্পতিবার
আপিল বিভাগে মুক্তিযোদ্ধা কোটা বাতিলের পরিপত্র অবৈধ ঘোষণার বিষয়ে শুনানির তারিখ নির্ধারিত ছিল এদিন। তবে প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের নেতৃত্বাধীন ছয় সদস্যের আপিল বিভাগ ‘নট টুডে’ বলে আদেশ দেন। পরের সপ্তাহে এ বিষয়ে শুনানি হতে পারে বলে ওই দিন অ্যাটর্নি জেনারেল কার্যালয় থেকে জানানো হয়। এদিন শিক্ষার্থীরা দেশের বিভিন্ন মহাসড়ক অবরোধ করে। আর ঢাকায় শাহবাগ মোড় অবরোধ করে রাখে পাঁচ ঘণ্টা। এদিন ছাত্রসমাবেশ থেকে ছাত্রধর্মঘটের ডাক দেওয়া হয়।
৫ জুলাই, শুক্রবার
চট্টগ্রাম, খুলনা ও গোপালগঞ্জে সড়ক অবরোধ করে আন্দোলনকারীরা। এ ছাড়া দেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বিক্ষোভ ও সড়ক অবরোধের ঘটনা ঘটে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পক্ষ থেকে পরদিন সারা দেশে বিক্ষোভ ও অবরোধ কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়।
৬ জুলাই, শনিবার
সব বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজে ক্লাস-পরীক্ষা বর্জন, ছাত্রধর্মঘট এবং সারা দেশে সড়ক-মহাসড়ক অবরোধের ডাক দেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়করা। এই কর্মসূচির নাম দেওয়া হয় ‘বাংলা ব্লকেড’। এদিন দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে বিক্ষোভ ও অবরোধ কর্মসূচি পালন করা হয়।
৭ জুলাই, রবিবার
শিক্ষার্থীদের বাংলা ব্লকেড কর্মসূচিতে স্থবির হয়ে পড়ে রাজধানী। বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজে ক্লাস ও পরীক্ষা বর্জনের ঘোষণা দেয় শিক্ষার্থীরা।
৮ জুলাই, সোমবার
‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’ প্ল্যাটফরম ৬৫ সদস্যের সমন্বয়ক টিম গঠন করে। সমন্বয়ক কমিটির সদস্য নাহিদ ইসলাম সরকারি চাকরিতে সব গ্রেডে অযৌক্তিক ও বৈষম্যমূলক কোটা বাতিল করে শুধু সংবিধান অনুযায়ী অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর জন্য ন্যূনতম কোটা রেখে সংসদে আইন পাসের দাবি জানান। এদিন ঢাকার ১১টি স্থানে, ৯টি বিশ্ববিদ্যালয়ে, তিনটি স্থানে রেলপথ অবরোধ এবং ছয়টি মহাসড়কে বাংলা ব্লকেড কর্মসূচি পালিত হয়।
৯ জুলাই, মঙ্গলবার
হাইকোর্টের পরিপত্র বাতিলের রায় স্থগিত চেয়ে দুই শিক্ষার্থী আপিল বিভাগে আবেদন করেন। পরদিন শুনানির তারিখ নির্ধারণ করা হয়। যদিও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়করা দাবি করেন, ওই দুই শিক্ষার্থীর আবেদন করার সঙ্গে তাঁদের কোনো সম্পর্ক নেই। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পক্ষ থেকে পরদিন সারা দেশে সকাল-সন্ধ্যা ‘বাংলা ব্লকেড’ নামে আবারও অবরোধ কর্মসূচির ঘোষণা দেওয়া হয়।
১০ জুলাই, বুধবার
কোটা বাতিলের পরিপত্র বাতিল চেয়ে সরকারের আবেদনসহ সব বিষয়ে স্থিতাবস্থা বজায় রাখতে নির্দেশ দেন প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের নেতৃত্বাধীন পাঁচ সদস্যের আপিল বিভাগ। শুনানির তারিখ নির্ধারণ করা হয় ৭ আগস্ট। শুনানির এক পর্যায়ে প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসান বলেন, ‘আমরা এই সমাজের মানুষ, কিছু কথা বলতেই হয়। সেটি হচ্ছে যে একটা রায় হাইকোর্টে হয়ে গেছে। ছাত্র-ছাত্রীরা আন্দোলন করছে। সেখানে তারা যেটা করেছে, এটা অ্যাপ্রিশিয়েট (প্রশংসা) করার মতো না। ম েন হয় তারা ভুল বুঝেই করেছে। যা-ই হোক, যেটিই করেছে, তারা আমাদেরই ছেলেমেয়ে।’ এদিন সকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের সামনে জড়ো হয়ে শাহবাগ অবরোধ করেন। টানা অবরোধ কর্মসূচিতে স্থবির হয়ে পড়ে সারা দেশ। রাজধানীর সঙ্গে সারা দেশের যোগাযোগ কার্যত বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে।
১১ জুলাই, বৃহস্পতিবার
বিকেল ৩টা থেকে শাহবাগ অবরোধের কথা থাকলেও বৃষ্টির ফলে শিক্ষার্থীরা শাহবাগে যাওয়ার পথে পুলিশের বাধা অতিক্রম করে সাড়ে ৪টায় শুরু করে। এদিন কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ওপর পুলিশ হামলা করে। রাত ৯টায় শিক্ষার্থীরা আন্দোলন শেষ করে তাদের ওপর পুলিশি হামলার প্রতিবাদে ১২ জুলাই বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশের ঘোষণা দেয়।
১২ জুলাই, শুক্রবার
বিকেল ৫টায় শিক্ষার্থীরা প্রশাসনের সতর্কবাণী উপেক্ষা করে শাহবাগে জড়ো হয়ে অবরোধ করে। কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের ওপর ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ ও এর নেতাকর্মীদের হামলা চালানোর খবর পাওয়া যায়।
১৩ জুলাই, শনিবার
সরকারি চাকরির সব গ্রেডে কোটার যৌক্তিক সংস্কারের দাবিতে রাষ্ট্রপতির কাছে স্মারকলিপি দেওয়ার কর্মসূচি ঘোষণা করে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। সন্ধ্যায় সংবাদ সম্মেলন করে তারা অভিযোগ করে—মামলা দিয়ে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে বাধার চেষ্টা করা হচ্ছে। পরের দিন গণপদযাত্রা করে রাষ্ট্রপতি বরাবর এই স্মারকলিপি দেওয়ার ঘোষণা দেয় আন্দোলনকারীরা।
১৪ জুলাই, রবিবার
জাতীয় সংসদে জরুরি অধিবেশন ডেকে সরকারি চাকরির সব গ্রেডের কোটার যৌক্তিক সংস্কারের দাবিতে সরকারকে ২৪ ঘণ্টা সময় বেঁধে দিয়ে রাষ্ট্রপতির কাছে স্মারকলিপি প্রদান করে কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীরা। এদিন গণভবনে চীন সফর উপলক্ষে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে মুক্তিযোদ্ধা কোটা প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘মুক্তিযোদ্ধাদের নাতিপুতিরা পাবে না? তাহলে কি রাজাকারের নাতিপুতিরা চাকরি পাবে?’
আন্দোলনকারীরা এই মন্তব্যকে তাদের জন্য অবমাননাকর মনে করে রাতে ঢাকা, জাহাঙ্গীরনগর, চট্টগ্রাম ও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে বিক্ষোভ মিছিল বের করে। সেসব মিছিলে শিক্ষার্থীরা স্লোগান দেয় : ‘তুমি কে আমি কে, রাজাকার রাজাকার/কে বলেছে কে বলেছে, স্বৈরাচার স্বৈরাচার’ কিংবা ‘চাইতে গেলাম অধিকার, হয়ে গেলাম রাজাকার’। ২০১৮ সালের আন্দোলন প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী জানান, সে সময় তিনি বিরক্ত হয়ে কোটা বাতিল করে দিয়েছিলেন। উদ্দেশ্য ছিল কোটা বাতিল হলে কী হয় সেটি দেখা। এই সময়ে বিসিএসে নারীরা বাদ পড়েছেন, ২৩টি জেলার কেউ পুলিশে চাকরি পাননি।
১৫ জুলাই, সোমবার
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সরকারি চাকরিতে কোটাবিরোধী আন্দোলনকারীদের উদ্দেশ্যে বলেন, নিজেদের রাজাকার বলতে তাদের লজ্জাও লাগে না। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের আন্দোলনকারীদের ‘রাজাকার’ স্লোগানের জবাব ছাত্রলীগই দেবে বলে মন্তব্য করেন। এর পর দুপুরে কোটা সংস্কার আন্দোলনে যাঁরা ‘আমি রাজাকার’ স্লোগান দিচ্ছেন, তাঁদের শেষ দেখিয়ে ছাড়বেন বলে মন্তব্য করেন বাংলাদেশ ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি সাদ্দাম হোসেন। বিকেল ৩টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে দফায় দফায় ছাত্রলীগ ও আন্দোলনকারীদের মধ্যে সংঘর্ষ বাধে। এ সময় আন্দোলনকারীদের মারধর করা হয়। গুলি করতেও দেখা যায়। দেশের বিভিন্ন স্থানে হামলা হয়। আহত ২৯৭ জন ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা নেন। হামলার প্রতিবাদে শিক্ষার্থীরা ১৬ জুলাই বিকেল ৩টায় সারা দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ কর্মসূচি ঘোষণা করেন।
১৬ জুলাই ২০২৪, মঙ্গলবার
আগের দিন বিভিন্ন শিক্ষপ্রতিষ্ঠানে ছাত্রলীগের হামলার ফলে বিক্ষোভ সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে। দিনভর দেশজুড়ে চলে ব্যাপক বিক্ষোভ ও সংঘর্ষ। আন্দোলনকারীদের ওপর পুলিশ টিয়ার গ্যাস, রাবার বুলেট ও ছররা গুলি নিক্ষেপ করে। আর ছাত্রলীগ-যুবলীগের সন্ত্রাসীরা দেশীয় অস্ত্রশস্ত্র এবং পিস্তল-বন্দুক নিয়ে হামলা করে। এতে নিহত হন ছয়জন, এর মধ্যে চট্টগ্রামে তিনজন, ঢাকায় দুজন এবং রংপুরে একজন। সরকার বিকেলে ঢাকা, চট্টগ্রাম, বগুড়া, রংপুর ও রাজশাহীতে বিজিবি মোতায়েন করে। রাতে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়সহ সারা দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করা হয়। মধ্যরাতে বন্ধ করে দেওয়া হয় মোবাইল (ফোরজি) নেটওয়ার্ক।
১৭ জুলাই, বুধবার
সকালে ‘রাজনীতিমুক্ত’ ঘোষণা করা হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়। কয়েক দফা হামলা-পাল্টাহামলার পর ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের বিভিন্ন ক্যাম্পাস থেকে বিতাড়ন করেন শিক্ষার্থীরা। দুপুর থেকেই সারা দেশে ছাত্র বিক্ষোভ, সড়ক-মহাসড়ক অবরোধ, গায়েবানা জানাজা, কফিন মিছিল এবং দফায় দফায় সংঘর্ষ ও পাল্টাপাল্টি ধাওয়ার ঘটনা চলতে থাকে। বন্ধ করে দেওয়া হয় ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট। সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায় জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, ‘আমার বিশ্বাস, আমাদের ছাত্রসমাজ উচ্চ আদালত থেকে ন্যায়বিচারই পাবে, তাদের হতাশ হতে হবে না।’ ছয়জন নিহত হওয়ার ঘটনায় বিচার বিভাগীয় তদন্তের নির্দেশ দেন তিনি।
১৮ জুলাই, বৃহস্পতিবার
সকাল থেকেই দেশব্যাপী প্রতিরোধ, সহিংসতা, সংঘর্ষ ও গুলির ঘটনা ঘটে। শিক্ষার্থীদের সর্বাত্মক অবরোধ কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে ঢাকাসহ সারা দেশ ছিল প্রায় অচল। রাজধানী ছাড়াও দেশের ৪৭টি জেলায় দিনভর বিক্ষোভ, অবরোধ, পাল্টাপাল্টি ধাওয়া, পুলিশের হামলা-গুলি ও সংঘাতে বাড়তে থাকে নিহতের সংখ্যা। অন্তত ৪১ জন নিহতের খবর পাওয়া যায় এদিন। আহত হয়ে হাসপাতালে ভর্তিদের মধ্যেও বাড়তে থাকে নিহতের সংখ্যা। ‘শিক্ষার্থীদের শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে পুলিশ, বিজিবি, র্যাব ও সোয়াটের ন্যক্কারজনক হামলা, খুনের প্রতিবাদ, খুনিদের বিচার, সন্ত্রাসমুক্ত ক্যাম্পাস নিশ্চিত করা এবং কোটাব্যবস্থার যৌক্তিক সংস্কারের দাবিতে’ কমপ্লিট শাটডাউন বা সর্বাত্মক অবরোধ কর্মসূচি পালন করেন শিক্ষার্থীরা। সারা দেশে বিজিবি মোতায়েন করা হয়।
১৯ জুলাই, শুক্রবার
কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ বা সর্বাত্মক অবরোধের কর্মসূচি ঘিরে রাজধানী ঢাকায় ব্যাপক সংঘর্ষ, হামলা, ভাঙচুর, গুলি, অগ্নিসংযোগ ও প্রাণহানির ঘটনা ঘটে। এদিন আরো বেশিসংখ্যক মানুষের মৃত্যু ঘটে। এদিন অন্তত ৭৫ জন নিহতের খবর পাওয়া যায়।
আন্দোলনে শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি বিভিন্ন এলাকার স্থানীয় জনসাধারণ ব্যাপকভাবে অংশগ্রহণ করে। রাত সাড়ে ৯টার দিকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক আব্দুল কাদের গণমাধ্যমে পাঠানো বার্তায় ৯ দফা দাবিতে কমপ্লিট শাটডাউন চলমান থাকার কথা জানান। এই ৯ দফা দাবির মধ্যে রয়েছে—আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে অবৈধ উপায়ে ব্যবহার করে ছাত্র হত্যার দায় নিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল এবং সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরকে মন্ত্রিপরিষদ ও দল থেকে পদত্যাগ করতে হবে।
২০ জুলাই, শনিবার
দেশজুড়ে কারফিউ, সেনা মোতায়েনের মধ্যেও যাত্রাবাড়ী, উত্তরা, বাড্ডা ও মিরপুর এলাকায় চলে সংঘর্ষ, ধাওয়া ও গুলি। এ ছাড়া মোহাম্মদপুরেও সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। ঢাকা, ময়মনসিংহ, গাজীপুর, সাভার ও নরসিংদীতে বিক্ষোভ ও সংঘর্ষে ৩৩ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া যায়। এর মধ্যে ঢাকার রামপুরা-বাড্ডা, যাত্রাবাড়ী-শনির আখড়া, উত্তরা ও মিরপুরে নিহত ১৬ জন, নারায়ণগঞ্জে পাঁচজন, ময়মনসিংহ ও সাভারে চারজন করে, গাজীপুর এবং নরসিংদীতে দুজন করে নিহত হন। সব মিলিয়ে চার দিনে নিহতের সংখ্যা দাঁড়ায় ১৪৮। ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের’ অন্যতম সমন্বয়ক নাহিদ ইসলামকে তুলে নেওয়ার অভিযোগ ওঠে। আন্দোলনের তিন সমন্বয়ক তিন মন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করে আট দফা দাবি পেশ করেন।
২১ জুলাই ২০২৪, রবিবার
সরকারি চাকরিতে নিয়োগের ক্ষেত্রে কোটা পুনর্বহালসংক্রান্ত হাইকোর্টের রায় সামগ্রিকভাবে বাতিল (রদ ও রহিত) করে দেশের সর্বোচ্চ আদালত রায় প্রদান করেন। রায়ে মেধার ভিত্তিতে ৯৩ শতাংশ; মুক্তিযোদ্ধা, শহীদ মুক্তিযোদ্ধা ও বীরাঙ্গনার সন্তানদের জন্য ৫ শতাংশ; ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী ১ শতাংশ এবং প্রতিবন্ধী ও তৃতীয় লিঙ্গের জনগোষ্ঠীর জন্য ১ শতাংশ কোটা নির্ধারণ করে দেওয়া হয়। তবে সরকার প্রয়োজন ও সার্বিক বিবেচনায় আদালত কর্তৃক নির্ধারিত কোটা বাতিল, সংশোধন বা সংস্কার করতে পারবে বলেও রায়ে উল্লেখ করা হয়। লক্ষণীয় বিষয়, এই রায়ের ফলে মুক্তিযোদ্ধার নাতি-নাতনি, নারী ও জেলা কোটা থাকল না। এই নির্দেশনার আলোকে সরকারের নির্বাহী বিভাগকে অনতিবিলম্বে প্রজ্ঞাপন জারি করতে নির্দেশ দেন আপিল বিভাগ।
২২ জুলাই ২০২৪, সোমবার
এদিন নতুন করে কোনো সংঘাতের খবর পাওয়া যায়নি। তবে ঢাকা মেডিক্যালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় পাঁচজনের মৃত্যু ঘটে। এ ছাড়া এর আগে মৃত আরো আটজনের খবর পাওয়া যায়, যার মধ্যে ২০ জুলাই নারায়ণগঞ্জে নিহত তিনজন, ১৯ জুলাই মিটফোর্ড হাসপাতালে চারজনের মৃতদেহ নেওয়া এবং ২২ জুলাই একজন পুলিশের মৃত্যুর খবর রয়েছে। সারা দেশে সংঘাতের ঘটনায় ১৭ থেকে ২২ জুলাই পর্যন্ত সারা দেশে গ্রেপ্তারের সংখ্যা দুই হাজার ছাড়িয়ে যায়। সারা দেশে চিরুনি অভিযানে ২১ জুলাই রবিবার রাত ১২টা থেকে ২২ জুলাই সোমবার সকাল ৬টা পর্যন্ত একা হাজার ২০০ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। এ সময় রাজধানীতে গ্রেপ্তার করা হয় ৫১৬ জনকে। ২০ জুলাই শনিবার রাত ১২টা থেকে ২১ জুলাই সকাল ৬টা পর্যন্ত ২৩৩ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। নিখোঁজ চার সমন্বয়কের খোঁজ পেতে ২৪ ঘণ্টা সময় বেঁধে দেয় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। এ সময়ের মধ্যে তাঁদের সন্ধান না পেলে অফিস ও বাসাবাড়ির সামনে কালো কাপড় বেঁধে মৌন প্রতিবাদ কর্মসূচি পালনের আহ্বান জানানো হয়। এই চার সমনবয়ক হলেন : আসিফ মাহমুদ, আবদুল কাদের, আবু বাকের মজুমদার ও সহসমন্বয়ক রশিদুল ইসলাম রিফাত।
২৩ জুলাই ২০২৪, মঙ্গলবার
সরকার ঘোষিত সাধারণ ছুটি ও কারফিউ চলা অবস্থায় কোনো সংঘাতের খবর পাওয়া যায়নি। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়করা এক সংবাদ সম্মেলন করে চার দফা ‘জরুরি দাবি’ পূরণে সরকারকে আরো দুই দিনের আলটিমেটাম দিয়ে জানান, এই চার দফা পূরণ না হলে আট দফা নিয়ে আলোচনার সুযোগ নেই। চার দফা দাবি হলো : ইন্টারনেট সচল করা; কারফিউ প্রত্যাহার করা; বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ তৈরি করা এবং আন্দোলনের সমন্বয়কদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। সংবাদ সম্মেলনে ১৮ জুলাই থেকে ‘নিখোঁজ’ তিনজন সমন্বয়ক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আসিফ মাহমুদ, আবু বাকের মজুমদার ও রশিদুল ইসলাম রিফাতের সন্ধান চাওয়া হয়। এই সমন্বয়কদের মুক্তি চেয়ে বিবৃতি দেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান ও সাবেক ২২ শিক্ষক।
২৪ জুলাই ২০২৪, বুধবার
এদিন সকাল ১০টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত কারফিউ শিথিল এবং সকাল ১১টা থেকে বিকেল ৩টা পর্যন্ত সরকারি-বেসরকারি অফিস খুলে দেওয়া হয়। ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট সীমিত আকারে নির্দিষ্ট কিছু এলাকায় খুলে দেওয়া হয়।
ঢাকাসহ বিভিন্ন জেলায় চিকিৎসাধীন আরো চারজনের মৃত্যু হয়। সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে বিক্ষোভ ও পরবর্তী সংঘাত নিয়ে মৃতের সংখ্যা দাঁড়ায় ২০১। মৃত্যুর এই হিসাব কিছু হাসপাতাল, মরদেহ নিয়ে আসা ব্যক্তি ও স্বজনদের সূত্রে পাওয়া। কোটা আন্দোলনের প্ল্যাটফরম বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক আসিফ মাহমুদ, আবু বাকের মজুমদার ও রশিদুল ইসলাম রিফাতের খোঁজ পাওয়া যায়। নিখোঁজ থাকার পাঁচ দিন পর আসিফ ও বাকেরকে চোখ বাঁধা অবস্থায় ফেলে যাওয়া হয়েছে বলে ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে দুজনই জানিয়েছেন। আর রিফাত আত্মগোপনে আছেন।
২৫ জুলাই, বৃহস্পতিবার
চিকিৎসাধীন আরো তিনজনের মৃত্যু। সব মিলিয়ে এখন পর্যন্ত মৃত্যু বেড়ে হয় ২০৪ জন। ছুটির দুই দিন, শুক্র ও শনিবার কারফিউ শিথিল থাকবে ৯ ঘণ্টা। অ্যামনেস্টি প্রতিবেদন দিয়ে বলেছে, প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার করেছে পুলিশ। প্রধানমন্ত্রীর মেট্রো স্টেশন পরিদর্শন। বললেন, ‘আমি জনগণের কাছে বিচার চাইছি।’
২৬ জুলাই, শুক্রবার
সারা দেশে আন্দোলনকারীদের ধরতে চলে পুলিশি অভিযান। সারা দেশে অন্তত ৫৫৫টি মামলায় গ্রেপ্তারের সংখ্যা দাঁড়ায় ছয় হাজার ২৬৪। নাহিদ ইসলামসহ কোটা সংস্কার আন্দোলনের শিক্ষার্থীদের প্ল্যাটফরম বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের তিন সমন্বয়ককে রাজধানীর গণস্বাস্থ্য নগর হাসপাতাল থেকে নিজেদের হেফাজতে নেয় ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। অপর দুই সমন্বয়ক হলেন আসিফ মাহমুদ ও আবু বাকের মজুমদার। তাঁরা তিনজনই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। একদল ব্যক্তি সাদা পোশাকে বিকেল সাড়ে ৩টার দিকে ধানমণ্ডির ওই হাসপাতাল থেকে তাঁদের তুলে নিয়ে যায়। সে সময় ওই ব্যক্তিরা নিজেদের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর সদস্য পরিচয় দেয়। সেখানে উপস্থিত এক সমন্বয়কের স্বজন ও হাসপাতালের চিকিৎসকরা এ তথ্য জানান।
২৭ জুলাই, শনিবার
কোটা সংস্কার আন্দোলনের প্ল্যাটফরম বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আরো দুই সমন্বয়ককে হেফাজতে নিয়েছে ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা শাখা (ডিবি)। তাঁরা হলেন সারজিস আলম ও হাসনাত আবদুল্লাহ। এই দুজনকেও ব্যক্তিগত নিরাপত্তা দিতে ও সাম্প্রতিক ঘটনাবলি সম্পর্কে তথ্য জানতে হেফাজতে নেওয়া হয়েছে বলে ডিবি জানায়। ১১ দিনে গ্রেপ্তার ৯ হাজার ১২১ জন। এর মধ্যে রাজধানীতে গ্রেপ্তার দুই হাজার ৫৩৬ জন। অন্যদিকে হাসপাতালে আরেক মৃত্যু। সব মিলিয়ে সংঘর্ষে নিহত বেড়ে হয় ২১০ জন। ঢাকায় কারফিউ শিথিল ১১ ঘণ্টা। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠানে (পঙ্গু হাসপাতাল) চিকিৎসাধীন আহত ব্যক্তিদের দেখতে গিয়েছেন। সরকারপ্রধান হাসপাতালে গুরুতর আহত চিকিৎসাধীন কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলেন এবং তাঁদের চিকিৎসার খোঁজখবর নেন। কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে দেশব্যাপী সংঘাতে আহত ব্যক্তিদের অনেকে এই হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। হাসপাতালে আহতদের দেখার পর সেতু ভবন, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিভাগ ও টোল প্লাজা দেখলেন প্রধানমন্ত্রী।
২৮ জুলাই, রবিবার
১০ দিন পর মোবাইল ইন্টারনেট সচল হয়। এদিন কোটা সংস্কার আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক নুসরাত তাবাসসুমকে হেফাজতে নেওয়ার কথা জানায় ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) গোয়েন্দা বিভাগ (ডিবি)। ডিবির হেফাজতে থাকা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ছয়জন সমন্বয়ক এক ভিডিও বার্তায় সব কর্মসূচি প্রত্যাহারের কথা বলেন। ডিবি কার্যালয়ে ধারণ করা একটি ভিডিও বার্তা রাত ৯টার দিকে গণমাধ্যমে পাঠানো হয়। ভিডিও বার্তায় কোটা সংস্কার আন্দোলনের প্ল্যাটফরম বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক নাহিদ ইসলামকে একটি লিখিত বক্তব্য পাঠ করতে দেখা যায়। লিখিত বক্তব্যে বলা হয়, ‘আমাদের প্রধান দাবি ছিল কোটার যৌক্তিক সংস্কার। এটি সরকার এরই মধ্যে পূরণ করেছে। এখন শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে দ্রুত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়ার জন্য সরকারের প্রতি জোর দাবি জানাই। সার্বিক স্বার্থে আমরা এই মুহূর্ত থেকে আমাদের সব কর্মসূচি প্রত্যাহার করছি।’
২৯ জুলাই, সোমবার
জামায়াত-শিবির নিষিদ্ধের সিদ্ধান্ত ১৪ দলের বৈঠকে। ৬ সমন্বয়ক ডিবি হেফাজতে। ‘জাতিকে নিয়ে মসকরা কইরেন না’, এক শুনানিতে এই মন্তব্য করেছেন হাইকোর্ট। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ‘কথিত আটক’ ছয়জন সমন্বয়ককে অবিলম্বে মুক্তি দিতে এবং দেশের বিভিন্ন স্থানে আন্দোলনকারীদের ওপর গুলি না চালাতে নির্দেশনা চেয়ে করা রিটের শুনানিতে রাষ্ট্রপক্ষের উদ্দেশে হাইকোর্ট এই মন্তব্য করেন। শুনানির এক পর্যায়ে অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল মোহাম্মদ মেহেদী হাছান চৌধুরী বলেন, ‘গতকাল টিভিতে দেখেছি, এই ছয়জন (সমন্বয়ক) কাঁটাচামচ দিয়ে খাচ্ছে।’ এক পর্যায়ে আদালত বলেন, ‘এগুলো করতে আপনাকে কে বলেছে? কেন করলেন এগুলো? জাতিকে নিয়ে মসকরা কইরেন না। যাকে নেন ধরে, একটি খাবার টেবিলে বসিয়ে দেন।’
৩০ জুলাই, মঙ্গলবার
হত্যার বিচার চেয়ে মুখে লাল কাপড় বেঁধে মিছিল। জাতিসংঘ মহাসচিবের বিবৃতি, স্বচ্ছ তদন্তের আহ্বান। কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে সংঘর্ষে নিহত ব্যক্তিদের স্মরণে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকের প্রফাইল লাল রঙের ফ্রেমে রাঙিয়েছে অনেকে। এসব ব্যক্তির মধ্যে শিক্ষক, সংস্কৃতিকর্মী, সাংবাদিক, লেখক, শিক্ষার্থীসহ নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ আছে। অন্যদিকে সরকার সমর্থকদের অনেকে ফেসবুক প্রফাইলে কালো রঙের ফ্রেম জুড়েছে। ‘মার্চ ফর জাস্টিস’ কর্মসূচি পালন করার ঘোষণা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের। ৯ দফা দাবি আদায়ের লক্ষ্যে এ কর্মসূচি পালন করা হবে দেশের সব আদালত, ক্যাম্পাস ও রাজপথে।
৩১ জুলাই, বুধবার
মার্চ ফর জাস্টিস কর্মসূচির পর বৃহস্পতিবারের জন্য নতুন কর্মসূচি ঘোষণা করেছে কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনকারী বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের একাংশ। এই দিনের কর্মসূচির নাম দেওয়া হয়েছে ‘রিমেম্বারিং আওয়ার হিরোস’। বুধবার সন্ধ্যায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সহসমন্বয়ক রিফাত রশিদের পাঠানো এক বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়। এতে বলা হয়, এমন ভয়ানক অন্ধকার পরিস্থিতিতে সারা দেশে ছাত্র-জনতার ওপর গণহত্যা, গণগ্রেপ্তার, হামলা-মামলা, গুম-খুন ও শিক্ষকদের ওপর ন্যক্কারজনক হামলার প্রতিবাদে, জাতিসংঘ কর্তৃক তদন্তপূর্বক বিচারের দাবিতে এবং ছাত্রসমাজের ৯ দফা দাবি আদায়ের লক্ষ্যে বৃহস্পতিবার বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ‘রিমেম্বারিং আওয়ার হিরোস’ কর্মসূচি ঘোষণা করছে।
১ আগস্ট, বৃহস্পতিবার
গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) হেফাজতে থাকা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ছয় সমন্বয়ককে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। দুপুর দেড়টার একটু পরেই তাঁরা ডিবি কার্যালয় থেকে কালো রঙের একটি গাড়িতে বেরিয়ে আসেন। রাতে ছাড়া পাওয়া অন্যতম সমন্বয়ক সারজিস আলমের ফেসবুক স্ট্যাটাস। তিনি লিখেছেন, ‘ছয় দিনের ডিবি হেফাজত দিয়ে ছয়জনকে আটকে রাখা যায়, কিন্তু এই বাংলাদেশের পুরো তরুণ প্রজন্মকে কিভাবে আটকে রাখবেন? দুর্নীতি, লুটপাট, অর্থপাচার, ক্ষমতার অপব্যবহার করে যে ক্ষোভ সৃষ্টি করেছেন প্রতিনিয়ত, সেগুলো কিভাবে নিবৃত্ত করবেন?’ জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী ছাত্রশিবিরকে নিষিদ্ধ করে প্রজ্ঞাপন জারি করে সরকার।
২ আগস্ট, শুক্রবার
২ আগস্ট গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) হেফাজত থেকে ছাড়া পাওয়া বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের ছয় সমন্বয়ক গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিবৃতিতে বলেন যে আন্দোলন প্রত্যাহার করে ডিবি অফিস থেকে প্রচারিত ছয় সমন্বয়কের ভিডিও বিবৃতি তাঁরা স্বেচ্ছায় দেননি। বিবৃতিদাতা মো. নাহিদ ইসলাম, সারজিস আলম, হাসনাত আব্দুল্লাহ, আসিফ মাহমুদ, নুসরাত তাবাসসুম ও আবু বাকের মজুমদারের ভাষ্য অনুযায়ী স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর নির্দেশেই তাঁদের আটকে রাখা হয়েছিল। এদিন দুপুর ১২টার পর থেকে মোবাইল নেটওয়ার্কে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক আবার বন্ধ করা হয়। পরবর্তী সময়ে পাঁচ ঘণ্টা পর ফেসবুক-মেসেঞ্জার আবার চালু করা হয়। এদিন সকালে রাজধানীর ধানমণ্ডিতে আবহানী মাঠ সংলগ্ন সড়কে হত্যাকাণ্ডের দায় স্বীকার করে অবিলম্বে সরকারের পদত্যাগসহ তিন দফা দাবিতে সমাবেশ ও বিক্ষোভ মিছিল করেছে গণহত্যা ও নিপীড়নবিরোধী শিল্পীসমাজ।
৩ আগস্ট, শনিবার
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আন্দোলনকারীদের আলোচনার প্রস্তাব দেন। তবে দুপুরে কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম জানান, সরকারের সঙ্গে আলোচনায় বসার কোনো পরিকল্পনা তাঁদের নেই। রাজধানীর আফতাবনগরের ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটির সামনে বিক্ষোভ সমাবেশ করে শিক্ষার্থীরা। রাজশাহীর বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের হাজারখানেক শিক্ষার্থী শনিবার সকাল সাড়ে ১০টার দিকে মিছিল বের করে রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (রুয়েট) সামনে জড়ো হয়ে স্লোগান দেয়। এদিন শিক্ষার্থীরা এক দফা, এক দাবি নিয়ে মাঠে নামে। তারা প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগ দাবি করে। কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে রাজধানীর ধানমণ্ডির রবীন্দ্রসরোবরে সংগীতশিল্পীদের প্রতিবাদী সমাবেশ হয়। বিকেল ৪টার পর বিক্ষুব্ধ জনতা বিরাট মিছিল নিয়ে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের দিকে যাত্রা শুরু করে। রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা থেকে বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার এলাকায় শিক্ষার্থী ও সাধারণ মানুষ একত্র হয়। বিকেল সাড়ে ৫টার দিকে শহীদ মিনারে সমবেত ছাত্র-জনতার উদ্দেশে বক্তব্য দেন কোটা সংস্কার আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া সংগঠনটির সমন্বয়ক মো. নাহিদ ইসলাম।
৪ আগস্ট, রবিবার
অসহযোগ আন্দোলনকে ঘিরে এদিন অনেক জেলায় পাল্টাপাল্টি ধাওয়া, সংঘর্ষ এবং গোলাগুলির ঘটনা ঘটে, এতে ৯৮ জন সাধারণ মানুষ ও পুলিশ নিহত হয়। লক্ষ্মীপুরে বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীদের পাল্টাপাল্টি ধাওয়া ও সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এ সময় গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হন এক কলেজছাত্র। আহত হয় অর্ধশতাধিক মানুষ। সকাল ১১টার দিকে জেলা শহরের উত্তর তেমুহনী থেকে ঝুমুর পর্যন্ত এলাকায় এ সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এ ছাড়াও সারা দেশের মধ্যে সংঘর্ষে সিরাজগঞ্জে পুলিশের ১৩ সদস্যসহ ২২ জন, রাজধানীতে ১১, ফেনীতে আট, লক্ষ্মীপুরে আট, নরসিংদীতে ছয়, সিলেটে পাঁচ, কিশোরগঞ্জে পাঁচ, বগুড়ায় পাঁচ, মাগুরায় চার, রংপুরে চার, পাবনায় তিন, মুন্সীগঞ্জে তিন, কুমিল্লায় পুলিশের সদস্যসহ তিন, শেরপুরে দুই, জয়পুরহাটে দুই, ভোলায় এক, হবিগঞ্জে এক, ঢাকার কেরানীগঞ্জে এক, সাভারে এক, বরিশালে এক, কক্সবাজারে এক ও গাজীপুরের শ্রীপুরে একজন নিহত হয়েছেন।
৫ আগস্ট, সোমবার মার্চ টু ঢাকা
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন মার্চ টু ঢাকা কর্মসূচির তারিখ পরিবর্তন করে ৬ আগস্টের পরিবর্তে ৫ আগস্ট সোমবার এ কর্মসূচি পালনের ঘোষণা দেন ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক আসিফ মাহমুদ। এতে সারা দেশ থেকে আন্দোলনকারীদের ঢাকায় আসার আহ্বান জানানো হয়। শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে দুপুর ২টা ৩০ মিনিটে বাংলাদেশ ছাড়েন। তাঁর বোন শেখ রেহানার সঙ্গে বিমানবাহিনীর হেলিকপ্টারে দেশত্যাগ করেন। শেখ হাসিনা যাওয়ার আগে একটি ভাষণ রেকর্ড করে যেতে চেয়েছিলেন। তিনি সে সুযোগ পাননি। ওই হেলিকপ্টারটি ভারতে অবতরণ করে। এ সময় গণভবনে অসংখ্য মানুষ ঢুকে পড়ে। তারা গণভবন লুট করে। বিকেল ৪টায় আওয়ামী লীগের ঢাকা জেলা কার্যালয়ে আগুন দেয় আন্দোলনকারীরা।
মঙ্গলবার (৬ আগস্ট) রাতে রাষ্ট্রপতির প্রেসসচিব জয়নাল আবেদীন এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন। তিনি বলেন, বঙ্গভবনে মঙ্গলবার রাতে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনের সঙ্গে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কসহ সংশ্লিষ্টদের বৈঠকে এ সিদ্ধান্ত হয়েছে।
বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনা করে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের বাকি সদস্যদের নাম চূড়ান্ত হবে।
এদিন সন্ধ্যা ৭টা ৪০ মিনিটে বর্তমান পরিস্থিতি ও অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের রূপরেখা নিয়ে আলোচনার জন্য বঙ্গভবনে প্রবেশ করেন সেনাপ্রধান, নৌপ্রধান ও বিমান বাহিনীর প্রধান।
এর আগে সন্ধ্যা সাড়ে ৬টার দিকে সেনাবাহিনীর একটি মাইক্রোবাসে বঙ্গভবনে প্রবেশ করেন কোটা সংস্কার আন্দোলনের প্ল্যাটফর্ম বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ১৩ সমন্বয়ক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আসিফ নজরুল এবং অধ্যাপক তানজীমউদ্দিন।
এর আগে মঙ্গলবার (৬ আগস্ট) ভোর ৪টার দিকে ফেসবুকে দেওয়া এক ভিডিও বার্তায় অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের রূপরেখা দেয় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। সেখানে নোবেলজয়ী অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে প্রধান উপদেষ্টা করা হয়।
All rights reserved © 2020-2024 dainikparibarton.com
অনুমতি ব্যতিত এই সাইটের কোনো কিছু কপি করা কপিরাইট আইনে দণ্ডনীয়।