বুধবার, ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০২:১১ অপরাহ্ন
মো:নূরুন নবী
রিপোর্টার, রাজশাহীঃ
রাজশাহী শিক্ষা বোর্ড কর্তৃপক্ষ দু-বার টেন্ডার করেও হাই স্পিড প্রিন্টার ক্রয় পারেনি । টেন্ডারের ঘটনায় চাহিদা ও সময়মতো মালামাল সরবরাহ না করার অভিযোগ উঠেছে সংশ্লিষ্ট
ঠিকাদারের বিরুদ্ধে। রাজশাহী শিক্ষা বোর্ড ঠিকাদারদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনলেও উল্টো
শিক্ষা বোর্ডকেই দায়ী করছে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান।
এদিকে, প্রিন্টার নষ্টের অজুহাতে মোটা অঙ্কের বাড়তি খরচে সার্টিফিকেট ও মার্কশিটসহ গুরুত্বপূর্ণ নথিপত্র প্রিন্ট করে আনা হচ্ছে ঢাকা থেকে। এ লক্ষ্যে রাজশাহী ও ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের মধ্যে চুক্তিও হয়েছে।
জানা গেছে, প্রতিষ্ঠার পর থেকেই বিভিন্ন পাবলিক পরীক্ষার প্রবেশপত্র, সার্টিফিকেট ও মার্কশিটসহ গুরুত্বপূর্ণ নথিপত্র নিজেরাই প্রিন্ট করত রাজশাহী শিক্ষা বোর্ড। কিন্তু প্রিন্টার নষ্টের অজুহাত দেখিয়ে এখন আর নথিপত্র প্রিন্ট করা হয় না। নতুন হেভিডিউটি অ্যান্ড হাইস্পিড প্রিন্টার কেনার জন্য ২০২২ সালের ২৪ এপ্রিল দরপত্র আহ্বান করা হয়। দরপত্রে ৬১ লাখ ৯ হাজার টাকায় সর্বনিম্ন দরদাতা নির্বাচিত হয় ইমাজিন কম্পিউটার অ্যান্ড সলিউশন নামের এক প্রতিষ্ঠান। গত বছরের ১১ জুন ঠিকাদারকে কার্যাদেশ দেওয়া হয়। চুক্তি অনুযায়ী দুই মাসের মধ্যে প্রিন্টার ও আনুষঙ্গিক উপকরণ সরববরাহের কথা ছিল।
কিন্তু নির্ধারিত সময়ের মধ্যে আংশিক মালামাল সরবরাহ করায় আবেদনের প্রেক্ষিতে কার্যাদেশের মেয়াদ বাড়ানো হয়। কিন্তু আন্তর্জাতিক বাজারে ডলারের দাম বৃদ্ধির অজুহাতে বাকি মালামাল আর সরবরাহ করেনি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান । এমন উদ্ভূত পরিস্থিতিতে ২০২১ সালের জেএসসি পরীক্ষার মূল সনদ, ২০২২ সালের এসএসসি ও এইচএসসির মার্কশিট এবং ২০২৩ সালের এসএসসি পরীক্ষার রেজিস্ট্রেশন কার্ড বাংলাদেশ মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড ঢাকা থেকে প্রিন্ট করানো হয়।
প্রথম দফায় রাজশাহী বোর্ডের ৭ লাখ ৩৮ হাজার ৮৩টি সনদ, মার্কশিট ও রেজিস্ট্রেশন কার্ড প্রিন্টের খরচ বাবদ মাদ্রাসা বোর্ডকে দিতে হয়েছে ১৯ লাখ টাকা। প্রতি কপি প্রিন্টের জন্য খরচ ধরা হয় আড়াই টাকা করে।
এদিকে মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড এ ধরনের সেবা রাজশাহী বোর্ডকে দিতে পারবে না বলে জানালে ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের সঙ্গে নতুন চুক্তি করে রাজশাহী শিক্ষা বোর্ড। ঢাকা শিক্ষা বোর্ড প্রতি কপি প্রিন্ট করতে দর বেঁধে দেয় ৩ টাকা ৭০ পয়সা। ঢাকা বোর্ডের সব শর্ত মেনে ২২ আগস্ট দুই বোর্ডের মধ্যে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। চুক্তিপত্রে উল্লেখ করা হয়, রাজশাহী শিক্ষা বোর্ডের রেজিস্ট্রেশন কার্ড, প্রবেশপত্র, মূল সনদ, একাডেমিক ট্রান্সক্রিপ্ট, নম্বরপত্র ও অন্যান্য ডকুমেন্টস ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের প্রিন্টারে প্রিন্ট করা হবে।
চুক্তিপত্রে ১২টি শর্ত দিয়েছে ঢাকা বোর্ড। এসব শর্তের অন্যতম হলো রাজশাহী বোর্ড প্রি-প্রিন্টেড সব ফরম নিজ খরচে ও দায়িত্বে ঢাকা শিক্ষা বোর্ডে পৌঁছে দেবে। যে কোনো কারণে ডকুমেন্টস ক্ষতিগ্রস্ত হলে, সে দায় রাজশাহী বোর্ডকেই বহন করতে হবে। রাজশাহী বোর্ড কর্তৃপক্ষ নিজস্ব জনবল ও পরিবহণ দিয়েই ডকুমেন্টস আনা-নেয়াসহ সব কাজ করবে। শুধু প্রিন্ট অপারেটর হিসাবে ঢাকা বোর্ডের একজন টেকনিশিয়ান দায়িত্ব পালন করবেন। ঢাকা বোর্ড কেবল প্রিন্টারের টোনার ও কালি সরবরাহ করবে।
এদিকে অভিযোগ উঠেছে, রাজশাহী বোর্ডের এ সংকট নিরসনের সক্ষমতা থাকলেও একটি মহল অসৎ উদ্দেশে পরীক্ষা সংক্রান্ত জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ ডকুমেন্টস বাইরে থেকে প্রিন্ট করাচ্ছেন। প্রিন্টিং কাজ তদারকির নামে প্রতিনিয়ত ঢাকা ভ্রমণ করেন বোর্ডের চেয়ারম্যান ও সচিবসহ সংশ্লিষ্ট শাখার কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। তাদের ভ্রমণ ব্যয়ও পরিশোধ করে রাজশাহী বোর্ড।
শিক্ষা বোর্ডের কম্পিউটার শাখার নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা বলেন, ‘আমরা বলেছিলাম আপাতত এক লাখ টাকার করে দুটি প্রিন্টার কিনে কাজ চালানো হোক। এতে বাইরে থেকে প্রিন্ট করানোর প্রয়োজন হবে না। কিন্তু কর্তৃপক্ষ তা আমলে নেয়নি। তারা ঢাকা থেকেই প্রিন্ট করাতে বেশি আগ্রহী। এর মধ্যে কী রহস্য আছে জানা নেই’।
রাজশাহী শিক্ষা বোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক অধ্যাপক আরিফুল ইসলাম বলেন, ‘শুনেছি প্রিন্টার নষ্ট। এ নিয়ে নানাজন নানা কথা বলেন। কোনটা সঠিক আমি জানি না। প্রিন্টার কেনার জন্য টেন্ডারও করা হয়েছিল। তাও সেটি আসেনি। এ নিয়ে আমি আর কোনো কথা বলতে চাই না’।
রাজশাহী শিক্ষা বোর্ডের সচিব অধ্যাপক হুমায়ুন কবীর বলেন, ‘আমাদের প্রিন্টার নষ্ট হয়ে যাওয়ায় শিক্ষার্থীদের গুরুত্বপূর্ণ ডকুমেন্টস করতে পারছিলাম না। তখন মাদ্রাসা বোর্ড থেকে প্রিন্ট করিয়েছিলাম। কিন্তু পরবর্তীতে তারা অসম্মতি জানানোর কারণে আমরা ঢাকা বোর্ডের শরণাপন্ন হয়েছি। আর নতুন প্রিন্টার কিনতে দরপত্র আহ্বান করে কার্যাদেশও দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মালামাল সরববরাহ করেনি। এ কারণে তাদের জামানত আটকে রাখা হয়েছে’।
তবে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ইমাজিন কম্পিউটার অ্যান্ড সলিউশনের মালিক এনএম আতিকুল হক বলেন, প্রথমে ২০২১ সালে টেন্ডার করেছিল রাজশাহী বোর্ড। সর্বনিম্ন দরদাতা হিসেবে আমরা কাজ পেলেও তারা কার্যাদেশ দিতে পারে নি। পরে ২০২২ সালে আবারও টেন্ডারে আমরাই কাজ পাই। এবারো তারা নানা কারণ দেখিয়ে কার্যাদেশ দিতে বিলম্ব করে। নতুন অর্থবছরে মালামালের দাম বেড়ে যায়। মূলতঃ শিক্ষা বোর্ডের গড়িমসির কারণে এই সংকট তৈরি হয়েছে। এরজন্য তারাই দায়ী। আমাদের জামানত আটকে রেখে অপ্রীতিকর পরিস্থিতি তৈরি করেছে’।
তবে নিজেদের সক্ষমতা না বাড়িয়ে অন্য শিক্ষা বোর্ড থেকে গুরুত্বপূর্ণ ডকুমেন্টস প্রিন্ট করানোকে জনগণের অর্থের অপচয় বলছেন বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ অধ্যাপক হবিবুর রহমান। তিনি বলেন, ‘রাজশাহী বোর্ড বহু পুরনো। তাদের তো টাকারও সংকট নেই। কিন্তু এমন সংকট তৈরি করে শিক্ষা বোর্ডের কোনো মহল আর্থিকভাবে ফায়দা লুটছে কি না তা খতিয়ে দেখা উচিত’।
All rights reserved © 2020-2024 dainikparibarton.com
অনুমতি ব্যতিত এই সাইটের কোনো কিছু কপি করা কপিরাইট আইনে দণ্ডনীয়।